মাসি। আচ্ছা মণি, অপরাধ হয়েছে, আমাকে মাপ করো। আমি শাশুড়ি হয়ে তোমাকে কিছু বলছি নে, আমি একজন সামান্য মেয়েমানুষের মতোই মিনতি করছি— যতীনের এই সময়ে তুমি যেয়ো না। যদি যাও তোমার বাবা রাগ করবেন, সে আমি নিশ্চয় জানি।
মণি। তা জানি, তোমাকে একলাইন লিখে দিতে হবে মাসি। এই কথা বোলো যে, আমি গেলে বিশেষ কোনো—
মাসি। তুমি গেলে কোনো ক্ষতিই নেই, সে কি আমি জানি নে। কিন্তু তোমার বাপকে যদি লিখতে হয়, আমার মনে যা আছে খুলেই লিখব।
মণি। আচ্ছা বেশ, তোমাকে লিখতে হবে না। আমি ওঁকে গিয়ে বললেই উনি—
মাসি। দেখো বউ, অনেক সয়েছি, কিন্তু এই নিয়ে যদি তুমি যতীনের কাছে যাও কিছুতেই সইব না।
মণি। আচ্ছা, থাক্ তোমাদের চিঠি। বাপের বাড়ি যাব তার এত হাঙ্গামা কিসের। উনি যখন জর্মনিতে পড়তে যেতে চেয়েছিলেন তখনই তো পাসপোর্টের দরকার হয়েছিল। আমার বাপের বাড়ি জর্মনি নাকি?
মাসি। আচ্ছা, আচ্ছা, অত চেঁচিয়ে কথা কোয়ো না। ঐ বুঝি আমাকে ডাকছে। যাই, যতীন। কী জানি, শুনতে পেয়েছে কি না।
মাসি। আমাকে ডাকছিলে, যতীন?
যতীন। হাঁ, মাসী। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলুম, উপায় নেই, আমি তো বন্দী; অসুখের জাল দিয়ে জড়ানো, দেয়াল দিয়ে ঘেরা— সঙ্গে সঙ্গে মণিকে কেন এমন বেঁধে রাখি।
মাসি। কী যে বলিস যতীন, তার ঠিক নেই। তোর সঙ্গে যে ওর জীবন বাঁধা, তুই খালাস দিতে চাইলেই কি ওর বাঁধন খসবে।
যতীন। একদিন ছিল যখন স্ত্রী সহমরণে যেত, সে অন্যায় তো এখন বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু মণির আজ এ যে পলে পলে সহমরণ, বেঁচে থেকে সহমরণ। মনে করে আমার প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে— এর থেকে ওকে দাও মুক্তি মাসি, দাও মুক্তি।
মাসি। আজ এমন কথা হঠাৎ কেন বলছিস, যতীন। স্বপ্নের ঘোরে এক কথা আর হয়ে তোর কানে পৌঁচেছিল নাকি।
যতীন। না না, অনেকক্ষণ ধরে ভাবছিলুম, ঝাউগাছের ঝরঝর শব্দ, নদীতে জোয়ার, দূরে বউ-কথা-কও পাখির ডাক। মনে পড়ছিল, মণির সেই কুসমিরঙের শাড়ি, আর কুকুরের সঙ্গে দেখাল, আর বিনা-কারণে হাসি। ওর দুরন্ত প্রাণ, এই মরা দেওয়ালগুলোর মধ্যে কেন। দাও ছুটি ওকে। কতদিন এ বাড়িতে ওর হাসিই শুনতে পাই নি। ওর স্রোতে নবীন জোয়ার, সে কি ঐসব ওষুধের শিশি, আর রুগীর পথ্যের বাঁধ বেঁধে আটকে দেবে। আমার মনে হচ্ছে, অন্যায়— ভারি অন্যায়।
মাসি। কিচ্ছু অন্যায় না, একটুও অন্যায় না। যার প্রাণ আছে সেই তো প্রাণ দিতে পারে! বর্ষণ তো ভরা মেঘের। উঠে বসিস্ নে যতীন, শো— অমন ছটফট করতে নেই। কোথায় মণিকে পাঠাতে চাস, বল্, আমি বুঝতে পারছি নে।
যতীন। নাহয় মণিকে ওর বাপের বাড়ি— ভুলে যাচ্ছি ওর বাবা এখন কোথায়—
মাসি। সীতারামপুরে।
যতীন। হাঁ, সীতারামপুরে। সে খোলা জায়গা, সেখানে ওকে পাঠিয়ে দাও।
মাসি। শোনো একবার। এই অবস্থায় তোমাকে ফেলে বাপের বাড়ি যেতে চাইবেই বা কেন।