ঢেউ দিয়ে তায় দিই-যে ঠেলে,
আপন-মনে স্থির হয়ে রই, করি নে চুরি।
ধরা দেওয়ার ধন সে তো নয়, অরূপ মাধুরী।
যতীন। মাসি, তোমরা কিন্তু বরাবর মনে করে এসেছ, মণির মন চঞ্চল— আমাদের ঘরে ওর মন বসে নি—কিন্তু দেখো—
মাসি। না বাবা, ভুল বুঝেছিলুম, সময় হলেই মানুষকে চেনা যায়।
যতীন। তুমি মনে করেছিলে, মণিকে নিয়ে আমি সুখী হতে পারি নি, তাই তার উপরে রাগ করতে। কিন্তু সুখ জিনিসটি ঐ তারাগুলির মতো অন্ধকারের ফাঁকে ফাঁকে দেখা দেয়। জীবনের ফাঁকে ফাঁকে কি স্বর্গের আলো জ্বলে নি। আমার যা পাবার তা পেয়েছি, কিছু বলবার নেই। কিন্তু মাসি, ওর তো অল্প বয়েস, ও কী নিয়ে থাকবে।
মাসি। অল্প বয়েস কিসের। আমরাও তো বাছা, ঐ বয়সেই দেবতাকে সংসারের দিকে ভাসিয়ে দিয়ে অন্তরের দিকে টেনে নিয়েছি। তাতে ক্ষতি হয়েছে কী। তাও বলি, সুখেরই বা এত বেশি দরকার কিসের।
যতীন। যখন থেকে শুনেছি মণি কেঁদেছে, তখন থেকেই বুঝেছি, ওর মন জেগেছে। ওকে একবার ডেকে দাও, মাসি। দুপুরবেলা একবার এসেছিল। তখন দিনের প্রথম আলো, দেখে হঠাৎ মনে হল, ওর মধ্যে ছায়া একটুও কোথাও নেই। একবার এই সন্ধের অন্ধকারে দেখতে দাও, হয়তো ওর ভিতরের সেই চোখের জলটুকু দেখতে পাব।
মাসি। তোমার কাছে ওর ভালোবাসা ঘোমটা খুলতে এখনো লজ্জা পায়, তাই ওর যত কান্না সবই আড়ালে।
যতীন। আচ্ছা, থাক্, থাক্, নাহয় আড়ালেই থাক্। কিন্তু সেই আড়ালের খবরটি মাসি, তুমি আমাকে দিয়ে যেয়ো। কেননা, যখন তার আড়ালটি সরে যাবে, তখন হয়তো— আজ কিন্তু সন্ধেবেলায় আমি তার সঙ্গে বিশেষ করে একটু কথা বলতে চাই।
মাসি। কী তোর এমন বিশেষ কথা আছে বল্ তো।
যতীন। আমার মণিসৌধ তৈরি শেষ হয়ে গেল, সেই খবরটা আপন মুখে তাকে দিতে চাই। গৃহপ্রবেশ আমার নয়, গৃহপ্রবেশ তাকেই করতে হবে— তার জন্যেই আমার এই সৃষ্টি, আমার এই ইঁটকাঠের বীণায় গান।
মাসি। সে বুঝি জানে না?
যতীন। তবু নিবেদন করে দিতে হবে। হিমিকে বলব, দরজার বাইরে থেকে ঐ গানটা গাইবে—
মোর জীবনের দান,
করো গ্রহণ করার পরম মূল্যে চরম মহীয়ান।—
যতীন। হিমি, শোন্ শোন্।—
হিমি। না দাদা, তুমি গেয়ো না, ডাক্তার বারণ করে।
যতীন। আমি গুন্গুন্ করে গাব। অনেক দিন পরে আমাদের কিনু বাউলের সেই গানটা আমার মনে পড়েছে।