আদিত্য। কেঁদো না নীরু, বলো কী করব। তুমি কি চাও সরলাকে বাগানের কাজে না রাখি?
নীরজা। (হাত ছিনিয়ে নিয়ে) কিচ্ছু চাই নে; কিচ্ছু না; ও তোমারই বাগান, তুমি যাকে খুশি রাখতে পারো আমার তাতে কী?
আদিত্য। নীরু, এমন কথা তুমি বলতে পারলে, আমারই বাগান? তোমার নয়? আমাদের মধ্যে এই ভাগ হয়ে গেল কবে থেকে?
নীরজা। যবে থেকে তোমার রইল বিশ্বের আর সমস্ত-কিছু, আর আমার রইল কেবল এই ঘরের কোণ। আমার এই ভাঙা প্রাণ নিয়ে দাঁড়াব কিসের জোরে তোমার ঐ আশ্চর্য সরলার সামনে! আমার সে শক্তি আজ কোথায় যে তোমার সেবা করি, তোমার বাগানের কাজ করি?
আদিত্য। নীরু, তুমি তো কতদিন এর আগে আপনি সরলাকে ডেকে পাঠিয়েছ, নিয়েছ ওর পরামর্শ। মনে নেই কি এই কয়েক বছর আগে বাতাবী নেবুর সঙ্গে কলম্বা নেবুর কলম বেঁধেছ দুইজনে, আমাকে আশ্চর্য করে দেবার জন্যে।
নীরজা। তখন তো ওর এত গুমর ছিল না। বিধাতা যে আমারই দিকে আজ অন্ধকার করে দিলে, তাই তো তোমার কাছে হঠাৎ ধরা পড়েছে— ও এত জানে, ও তত জানে, অর্কিড চিনতে আমি ওর কাছে লাগি নে। সেদিন তো এ-সব কথা কোনোদিন শুনি নি। তবে আজ আমার এই দুর্ভাগ্যের দিনে কেন তুলনা করতে এলে? আর আমি ওর সঙ্গে পারব কেন? মাপে সমান হব কী নিয়ে?
আদিত্য। নীরু, আজ তোমার কাছে এই যা-সব শুনছি তার জন্য একটুও প্রস্তুত ছিলুম না। মনে হচ্ছে এ যেন আমার নীরুর কথা নয়, এ যেন আর কেউ।
নীরজা। না গো না, সেই নীরুই বটে। তার কথা এতদিনেও তুমি বুঝলে না এই আমার সব চেয়ে শাস্তি। বিয়ের পর যেদিন আমি জেনেছিলেম তোমার বাগান তোমার প্রাণের মতো প্রিয়, সেদিন থেকে ঐ বাগান আর আমার মধ্যে ভেদ রাখি নি একটুও। নইলে তোমার বাগানের সঙ্গে আমার ভীষণ ঝগড়া বাধত। ওকে সইতে পারতুম না। ও হত আমার সতীন। তুমি তো জানো আমার দিনরাতের সাধনা। জানো কেমন করে ওকে মিলিয়ে নিয়েছি আমার মধ্যে। একেবারে এক হয়ে গেছি ওর সঙ্গে।
আদিত্য। জানি বৈকি। আমার সব-কিছুকে নিয়েই যে তুমি।
নীরজা। ও-সব কথা রাখো। আজ দেখলুম ঐ বাগানের মধ্যে অনায়াসে প্রবেশ করলে আর-একজন, কোথাও একটুকু ব্যথা লাগল না। আমার দেহখানাকে চিরে ফেলবার কথা কি মনে করতেও পারতে, আর কারু প্রাণ তার মধ্যে চালিয়ে দেবার জন্যে? আমার বাগান কি আমার দেহ নয়? আমি হলে কি এমন করতে পারতুম? আদিত্য। কী করতে তুমি?
নীরজা। বলব কী করতুম? বাগান ছারখার হয়ে যেত হয়তো। ব্যাবসা হত দেউলে। একটার জায়াগায় দশটা মালী রাখতুম কিন্তু আসতে দিতুম না আর-কোনো মেয়েকে। বিশেষত এমন কাউকে যার মনে গুমর আছে সে আমার চেয়েও বাগানের কাজ ভালো জানে। ওর এই অহংকার দিয়ে তুমি আমাকে অপমান করবে প্রতিদিন, যখন আমি আজ মরতে বসেছি, যখন উপায় নেই নিজের শক্তির প্রমাণ করবার। এমনটা কেন হতে পারল বলব?
আদিত্য। বলো।