সুদর্শনা। ও কে ও! চেয়ে দেখ্ সুরঙ্গমা, এত রাত্রে এই আঁধারে পথে আরও একজন পথিক বেরিয়েছে যে।
সুরঙ্গমা। মা, এ যে বিক্রম রাজা দেখছি!
সুদর্শনা। বিক্রম রাজা?
সুরঙ্গমা। ভয় করো না।
সুদর্শনা। ভয়! ভয় কেন করব। ভয়ের দিন আমার আর নেই।
বিক্রম। তুমিও চলেছ বুঝি। আমিও এই এক পথেরই পথিক। আমাকে কিছুমাত্র ভয় কোরো না।
সুদর্শনা। ভালোই হয়েছে বিক্রমরাজ – আমরা দুজনে তাঁর কাছে পাশাপাশি চলেছি এ ঠিক হয়েছে। ঘর ছেড়ে বেরোবার মুখেই তোমার সঙ্গে আমার যোগ হয়েছিল— আজ ঘরে ফেরবার পথে সেই যোগই যে এমন শুভযোগ হয়ে উঠবে তা আগে কে মনে করতে পারত!
বিক্রম। কিন্তু তুমি যে হেঁটে চলেছ এ তো তোমাকে শোভা পায় না। যদি অনুমতি কর তাহলে এখনই রথ আনিয়ে দিতে পারি।
সুদর্শনা। না না, অমন কথা বলো না – যে-পথ দিয়ে তাঁর কাছ থেকে দূরে এসেছি, সেই পথের সমস্ত ধুলোটা পা দিয়ে মাড়িয়ে মাড়িয়ে ফিরব তবেই আমার বেরিয়ে আসা সার্থক হবে। রথে করে নিয়ে গেলে আমাকে ফাঁকি দেওয়া হবে।
সুরঙ্গমা। মহারাজ, তুমিও তো আজ ধুলোয়। এ পথে তো হাতি ঘোড়া রথ কারও দেখি নি।
সুদর্শনা। যখন প্রাসাদে ছিলুম তখন কেবল সোনারুপোর মধ্যেই পা ফেলেছি – আজ তাঁর ধুলোর মধ্যে চলে আমার সেই ভাগ্যদোষ খণ্ডিয়ে নেব। আজ আমার সেই ধুলোমাটির রাজার সঙ্গে পদে পদে এই ধুলোমাটিতে মিলন হচ্ছে, এ সুখের খবর কে জানত।
সুরঙ্গমা। ঐ দেখো, পূর্বদিকে চেয়ে দেখো ভোর হয়ে আসছে। আর দেরি নেই – তাঁর প্রাসাদের সোনার চূড়ার শিখর দেখা যাচ্ছে।
ঠাকুরদা। ভোর হল, দিদি ভোর হল।
সুদর্শনা। তোমাদের আশীর্বাদে পৌঁছেছি।
ঠাকুরদা। কিন্তু আমাদের রাজার রকম দেখেছ? রথ নেই, বাদ্য নেই, সমারোহ নেই।
সুদর্শনা। বল কী, সমারোহ নেই? ওই যে আকাশ একেবারে রাঙা, ফুলগন্ধের অভ্যর্থনায় বাতাস একেবারে পরিপূর্ণ।
ঠাকুরদা। তা হোক, আমাদের রাজা যত নিষ্ঠুর হোক আমরা তো তেমন কঠিন হতে পারি নে — আমাদের যে ব্যথা লাগে। এই দীনবেশে তুমি রাজভবনে যাচ্ছ, এ কি আমরা সহ্য করতে পারি? একটু দাঁড়াও, আমি ছুটে গিয়ে তোমার জন্যে রানীর বেশ নিয়ে আসি।
সুদর্শনা। না না না। সে বেশ তিনি আমাকে চিরদিনের মতো ছাড়িয়েছেন – সবার সামনে আমাকে দাসীর বেশ পরিয়েছেন– বেঁচেছি বেঁচেছি – আমি আজ তাঁর দাসী – যে-কেউ তাঁর আছে, আমি আজ সকলের নীচে।
ঠাকুরদা। শত্রুপক্ষ তোমার এ দশা দেখে পরিহাস করবে, সেইটে আমাদের অসহ্য হয়।
সুদর্শনা। শত্রুপক্ষের পরিহাস অক্ষয় হোক – তারা আমার গায়ে ধুলো দিক! আজকের দিনের অভিসারে সেই ধুলোই আমার