এমন একটি দৃষ্টান্ত দিলাম। কিন্তু তাহার জীবনের সকল কার্যেই দেখা গিয়াছে, তিনি যে চেতনারাজ্যে, যে মননলোকে বাস করিতেন, আমরা তাহা হইতে বহু দূরে অবস্থিত; তাঁহার চিন্তা ও চেষ্টা, বুদ্ধি ও বেদনা গতানুগতিকের মতো ছিল না, তাহা পারমার্থিক ছিল।
তাঁহার মতো লোক পারমার্থিকতাভ্রষ্ট বঙ্গদেশে জন্মিয়াছিলেন বলিয়া, চতুর্দিকের নিঃসাড়তার পাষাণখণ্ডে বারম্বার আহত-প্রতিহত হইয়াছিলেন বলিয়া, বিদ্যাসাগর তাঁহার কর্মসংকুল জীবন যেন চিরদিন ব্যথিতক্ষুব্ধভাবে যাপন করিয়াছেন। তিনি যেন সৈন্যহীন বিদ্রোহীর মতো তাঁহার চতুর্দিককে অবজ্ঞা করিয়া জীবনরণরঙ্গভূমির প্রান্ত পর্যন্ত জয়ধ্বজা নিজের স্কন্ধে একাকী বহন করিয়া লইয়া গেছেন। তিনি কাহাকেও ডাকেন নাই, তিনি কাহারো সাড়াও পান নাই, অথচ বাধা ছিল পদে পদে। তাঁহার মননজীবী অন্তঃকরণ তাঁহাকে প্রবল আবেগে কাজ করাইয়াছিল, কিন্তু গতজীবন বহিঃসংসার তাঁহাকে আশ্বাস দেয় নাই। তিনি যে শবসাধনায় প্রবৃত্ত ছিলেন তাহার উত্তরসাধকও ছিলেন তিনি নিজে।
আধুনিক ইংলণ্ডে বিদ্যাসাগরের ঠিক উপমা পাওয়া যায় না। কেবল জন্সনের সহিত কতকগুলি বিষয়ে তাঁহার অত্যন্ত সাদৃশ্য দেখিতে পাই। সে সাদৃশ্য বাহিরের কাজে ততটা নয়–কারণ, কাজে বিদ্যাসাগর জন্সন্ অপেক্ষা অনেক বড়ো ছিলেন, কিন্তু এই সাদৃশ্য অন্তরের সরল প্রবল এবং অকৃত্রিম মনুষ্যত্বে। জন্সন্ও বিদ্যাসাগরের ন্যায় বাহিরে রূঢ় ও অন্তরে সুকোমল ছিলেন; জন্সন্ও পাণ্ডিত্যে অসামান্য, বাক্যালাপে সুরসিক, ক্রোধে উদ্দীপ্ত, স্নেহরসে আর্দ্র, মতে নির্ভীক, হৃদয়ভাবে অকপট এবং পরহিতৈষায় আত্মবিস্মৃত ছিলেন। দুর্বিষহ দারিদ্র্যও মুহূর্তকালের জন্য তাঁহার আত্মসম্মান আচ্ছন্ন করিতে পারে নাই। সুবিখ্যাত ইংরাজিলেখক লেস্লি স্টিফেন জন্সন্ সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন তাহার কিয়দংশ অনুবাদ করিয়া দিলাম-
‘মতের পরিবর্তে কেবল কথামাত্র-দ্বারা তাঁহাকে ভুলাইবার জো ছিল না, এবং তিনি এমন কোনো মতবাদও গ্রাহ্য করিতেন না যাহা অকৃত্রিম আবেগ-উৎপাদনে অক্ষম। ইহা ব্যতীত, তাঁহার হৃদয়বৃত্তিসকল যেমন অকৃত্রিম তেমনি গভীর এবং সুকোমল ছিল। তাঁহার বৃদ্ধা এবং কুশ্রী স্ত্রীর প্রতি তাঁহার প্রেম কী পবিত্র ছিল! যেখানে কিছুমাত্র উপকারে লাগিত সেখানে তাঁহার করুণা কিরূপ সবেগে অগ্রসর হইত, ‘গ্রাব স্ট্রীট্’-এর সর্বপ্রকার প্রলোভন হইতে তিনি কিরূপ পুরুষোচিত আত্মসম্মানের সহিত আপন সম্ভ্রমরক্ষা করিয়াছিলেন, সে-সব কথার পুনরুল্লেখের প্রয়োজন নাই। কিন্তু বোধ করি, এ-সকল গুণের একান্ত দুর্লভতা সম্বন্ধে মনোযোগ আকর্ষণ করা ভালো। বোধ হয় অনেকেই আপন পিতাকে ভালোবাসে–সৌভাগ্যক্রমে তাহা সত্য–কিন্তু কটা লোক আছে যাহার পিতৃভক্তি খেপামি-অপবাদের আশঙ্কা অতিক্রম করিতে পারে। কয়জন আছেন যাঁহারা বহুদিনগত এক অবাধ্যতা-অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত-সাধনের জন্য য়ুটক্রসিটারের হাটে পিতার মৃত্যুর বহুবৎসর পরেও যাত্রা করিতে পারেন। সমাজত্যক্তা রমণী পথপ্রান্তে নিরাশ্রয়ভাবে পড়িয়া আছে দেখিলে আমাদের অনেকরেই মনে ক্ষণিক দয়ার আবেশ হয়। আমরা হয়তো পুলিসকে ডাকি কিম্বা ঠিকাগাড়িতে চড়াইয়া দিয়া তাহাকে সরকারি দরিদ্রাশ্রমে পাঠাই, অথবা বড়োজোর সরকারি দরিদ্রপালনব্যবস্থার অসম্পূর্ণতার বিরুদ্ধে টাইম্স্ পত্রে প্রবন্ধ লিখিয়া পাঠাই। কিন্তু এ প্রশ্ন বোধ করি জিজ্ঞাসা না করাই ভালো যে, কয়জন সাধু আছেন যাঁহারা তাহাকে কাঁধে করিয়া নিজের বাড়িতে লইয়া যাইতে পারেন এবং তাহার অভাবসকল মোচন করিয়া দিয়া তাহার জীবনযাত্রার সুব্যবস্থা করিয়া দেন। অনেক বড়োলোকের জীবনে আমরা সাধুভাব ও সদাচার দেখিতে পাই; কিন্তু ভালো লোকের মধ্যেও এমন আদর্শ সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায় না যাঁহার জীবন প্রচলিত লোকাচারের দ্বারা গঠিত নহে অথবা যাঁহার হৃদয়বৃত্তি চিরাভ্যস্ত শিষ্টপ্রথার বাঁধা খাল উদ্ববেল করিয়া উঠিতে পারে। জন্সনের চরিত্রের প্রতি আমাদের যে প্রীতি জন্মে তাহার প্রধান কারণ, তাঁহার জীবন যে নেমি আশ্রয় করিয়া আবর্তিত হইত তাহা