এই বর্ণনা পাঠ করিলে বিদ্যাসাগরের সহিত জন্সনের সাদৃশ্য সহজেই মনে পড়ে। বিদ্যাসাগরও কেবল ক্ষুদ্র সংকীর্ণ অভ্যস্ত ভব্যতার মধ্য দিয়া চলিতে পারেন নাই, তাঁহারও স্নেহভক্তিদয়া, তাঁহার বিপুলবিস্তীর্ণ হৃদয়, সমস্ত আদব-কায়দাকে বিদীর্ণ করিয়া কেমন অসামান্য আকারে ব্যক্ত হইত তাহা তাঁহার জীবনচরিতে নানা ঘটনায় প্রকাশ পাইয়াছে।
এইখানে জন্সন্ সম্বন্ধে কার্লাইল যাহা লিখিয়াছেন তাহার কিয়দংশ অনুবাদ করি-
‘তিনি বলিষ্ঠচেতা এবং মহৎ লোক ছিলেন। শেষ পর্যন্তই অনেক জিনিস তাঁহার মধ্যে অপরিণত থাকিয়া গিয়াছিল; অনুকূল উপকরণের মধ্যে তিনি কী না হইতে পারিতেন–কবি, ঋষি, রাজাধিরাজ। কিন্তু মোটের উপরে, নিজের ‘উপকরণ’, নিজের ‘কাল’ এবং ঐগুলা লইয়া নালিশ করিবার প্রয়োজন কোনো লোকেরই নাই; উহা একটা নিস্ফল আক্ষেপমাত্র। তাঁহার কালটা খারাপ ছিল, ভালোই; তিনি সেটাকে আরো ভালো করিবার জন্যই আসিয়াছেন। জন্সনের কৈশোরকাল ধনহীন, সঙ্গহীন, আশাহীন এবং দুর্ভাগ্যজালে বিজড়িত ছিল। তা থাক্, কিন্তু বাহ্য অবস্থা অনুকূলতম হইলেও জন্সনের জীবন দুঃখের জীবন হওয়া ছাড়া আর-কিছু হওয়া সম্ভবপর হইত না। প্রকৃতি তাঁহার মহত্ত্বের প্রতিদানস্বরূপ তাঁহাকে বলিয়াছিল, রোগাতুর দুঃখরাশির মধ্যে বাস করো। না, বোধ করি; দুঃখ এবং মহত্ত্ব ঘনিষ্ঠভাবে, এমন-কি, অচ্ছেদ্যভাবে পরস্পর জড়িত ছিল। যে কারণেই হউক, অভাগা জন্সন্কে নিয়তই রোগাবিষ্টতা, শারীরিক ও অধ্যাত্মিক বেদনা, কোমরে বাঁধিয়া ফিরিতে হইত। তাঁহাকে একবার কল্পনা করিয়া দেখো–তাঁহার সেই রুগ্ণ শরীর, তাঁহার ক্ষুধিত প্রকাণ্ড হৃদয় এবং অনির্বচনীয় উদ্বর্তিত চিন্তাপুঞ্জ লইয়া পৃথিবীতে বিপদাকীর্ণ বিদেশীর মতো ফিরিতেছেন, ব্যগ্রভাবে গ্রাস করিতেছেন যে-কোনো পারমার্থিক পদার্থ তাঁহার সম্মুখে আসিয়া পড়ে, আর যদি কিছুই না পান তবে অন্তত বিদ্যালয়ের ভাষা এবং কেবলমাত্র ব্যাকরণের ব্যাপার! সমস্ত ইংলণ্ডের মধ্যে বিপুলতম অন্তঃকরণ যাহা ছিল তাঁহারই ছিল, অথচ তাঁহার জন্য বরাদ্দ ছিল সাড়ে চার আনা করিয়া প্রতিদিন। তবু সে হৃদয় ছিল অপরাজিত মহাবলী, প্রকৃত মনুষ্যের হৃদয়! অক্সস্পর্ফোডে তাঁহার সেই জুতাজোড়ার গল্পটা সর্বদাই মনে পড়ে–মনে পড়ে, কেমন করিয়া সেই দাগ-কাটা-মুখ হাড়-বাহির-করা কলেজের দীন ছাত্র শীতের সময় জীর্ণ জুতা লইয়া ঘুরিয়া বেড়ইতেছে; কেমন করিয়া কে কৃপালু সচ্ছল ছাত্র গোপনে একজোড়া জুতা তাঁহার দরজার কাছে রাখিয়া দিল, এবং সেই হাড়-বাহির-করা দরিদ্র ছাত্র সেটা তুলিল, কাছে আনিয়া তাহার বহুচিন্তাজালেঅস্ফুট দৃষ্টির নিকট ধরিল এবং তাহার পরে জানালার বাহিরে দূর করিয়া ছুঁড়িয়া ফেলিল। ভিজা পা বল, পঙ্ক বল, বরফ বল, ক্ষুধা বল, সবই সহ্য হয়, কিন্তু ভিক্ষা নহে। আমরা ভিক্ষা সহ্য করিতে পারি না। এখানে কেবল রূঢ় আত্মসহায়তা। দৈন্য, মালিন্য, উদ্ভ্রান্ত বেদনা এবং অভাবের অন্ত নাই, তথাপি অন্তরের মহত্ত্ব এবং পৌরুষ! এই-যে জুতা ছুঁড়িয়া ফেলা, ইহাই এ মানুষটির জীবনের ছাঁচ। একটি স্বকীয়তন্ত্র (original) মানুষ; এ তোমার গতানুগতিক, ঋণপ্রার্থী, ভিক্ষাজীবী লোক নহে। আর যাই হউক, আমরা নিজের ভিত্তির উপরেই যেন স্থিতি করি–সেই জুতা পায়ে দিয়াই দাঁড়ানো যাক যাহা আমরা নিজে জোটাইতে পারি।