বাস্তবিক, একটু ভাবিয়া দেখিলেই দেখা যায়, জ্ঞানের কথায় আর ভাবের কথায় একই নিয়ম খাটে না। জ্ঞানের কথাকে ভাষান্তরিত করিলে তাহার তেমন ক্ষতি হয় না, কিন্তু ভাবের কথাকে ভাষাবিশেষ হইতে উৎপাটিত করিয়া তাহাকে ভাষান্তরে রোপণ করিলে তাহার স্ফূর্তি থাকে না, তাহার ফুল হয় না, ফল হয় না, সে ক্রমে মরিয়া যায়। আমি ভারতবাসী যখন ঈশ্বরকে দয়াময় বলিয়া ডাকি তখন সেই ‘দয়াময়’ শব্দ সমস্ত অতীত ও বর্তমান ভারতবাসীর বিরাট হৃদয় হইতে প্রতিধ্বনিত হইয়া সমস্ত ভারতবর্ষের আকাঙ্ক্ষা কুড়াইয়া লইয়া কী সুগম্ভীর ধ্বনিতে ঈশ্বরের নিকটে গিয়া উত্থিত হয়! আর, অনুবাদ করিয়া তাঁহাকে যদি লনক্ষদভপয়র বলিয়া ডাকি, তবে ওয়েব্স্টার্স্ ডিক্শনারির গোটাকতক শুষ্ক পত্রের মধ্যে সে শব্দ মর্মর করিয়া উঠে মাত্র। অতএব, ভাবের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদারতা খাটে না। আজকালকার অনেক ধর্ম-প্রবন্ধে দেখিতে পাওয়া যায়, অনেকে ইংরাজি পতভঢ়বশব্দকে অনুবাদ করিয়া ‘বিশ্বাস’-নামক শব্দ ব্যবহার করিয়া থাকেন। ইহাতে তাঁহাদের হৃদয়হীনতা প্রকাশ পায়; প্রকাশ পায় যে, হৃদয়ের অভাব-বশত স্বদেশীয় ভাষার অমূল্য ভাবের ভাণ্ডার তাঁহাদের নিকটে রুদ্ধ রহিয়াছে। বিশ্বাস শব্দের বিশেষ স্থলে বিশেষ প্রয়োগ আছে, কিন্তু ভক্তি শব্দের স্থলে বিশ্বাস শব্দের প্রয়োগ অসহ্য। অলীক উদারতার প্রভাবে স্বদেশীয় ভাবের প্রতি সংকীর্ণ দৃষ্টি জন্মিলে এইসেকল উপদ্রব ঘটিয়া থাকে। আমাদের দেশে যদি সস্তা কাপড় সহজে কিনিতে পাওয়া যায়, তবে তাহার উপরে মাশুল বসাইয়া সেই জিনিসটাই আর-এক আকারে বিলাত হইতে আমদানি করাইলে দেশের কিরূপ শ্রীবৃদ্ধি করা হয়? সর্বসাধারণে কি সে কাপড় সহজে পরিতে পায়? এক হিসাবে বিলাতের পক্ষে উদারতা করা হয় সন্দেহ নাই, কিন্তু ইহাকে প্রকৃত উদারতা বলে না। আমি নিজের গৃহ নির্মাণ করিতেছি বলিয়া কি সকলে বলিবে, আমি হৃদয়ের সংকীর্ণতা-বশত পরের সহিত স্বতন্ত্র হইতেছি। স্বগৃহ না থাকিলে আমি পরকে আশ্রয় দিব কী করিয়া? রামমোহন রায় সেই স্বগৃহ দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহিলেন। অথচ স্পষ্ট দেখা গিয়াছে, পরের প্রতি তাঁহার বিদ্বেষ ছিল না। তাঁহাকে অনুদার বলিতে চাও তো বলো।
উদ্ভিজ্জ ও পশুমাংসের মধ্যে যে জীবনীশক্তি আছে তাহা যে আমরা স্বায়ত্ত করিতে পারি তাহার কারণ–আমাদের নিজের জীবন আছে বলিয়া। আমাদের নিজের প্রাণ না থাকিলে আমরা নূতন প্রাণ উপার্জন করিতে পারি না। আমাদের প্রাণ না থাকিলে উদ্ভিজ্জ পশু পক্ষী কীট প্রভৃতি অন্য প্রাণীরা আমাদিগকে গ্রহণ করিত। এ জগতে মৃত টিকিতে পারে না, জীবিতের মধ্যে বিলীন হইয়া যায়। রামমোহন রায় যদি দেখিতেন আমাদের জীবন নাই, তবে পারসিক মৃতদেহের ন্যায় আমাদিগকে মৃতভবনে ফেলিয়া রাখিতে দিতেন, খ্রীস্টধর্ম প্রভৃতি অন্যান্য জীবিত প্রাণীর উদরস্থ হইতে দিতেন। কিন্তু তাহা না করিয়া তিনি চিকিৎসা শুরু করিয়া দিলেন।