রচনার সুবিধার জন্য আমার পাঁচটি পারিপার্শ্বিককে পঞ্চভূত নাম দেওয়া যাক–ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। একটা গড়া নাম দিতে গেলেই মানুষকে বদল করিতে হয়। তলোয়ারের যেমন খাপ, মানুষের তেমন নামটি ভাষায় পাওয়া অসম্ভব। বিশেষত ঠিক পাঁচ ভূতের সহিত পাঁচটা মানুষ অবিকল মিলাইব কী করিয়া?
আমি ঠিক মিলাইতেও চাহি না। আমি তো আদালতে উপস্থিত হইতেছি না। কেবল পাঠকের এজলাসে লেখকের একটা এই ধর্মশপথ আছে যে, সত্য বলিব। কিন্তু সে সত্য বানাইয়া বলিব।
এমন পঞ্চভূতের পরিচয় দিই।
শ্রীযুক্ত ক্ষিতি আমাদের সকলের মধ্যে গুরুভার। তাঁহার অধিকাংশ বিষয়েই অচল অটল ধারণা। তিনি যাহাকে প্রত্যক্ষভাবে একটা দৃঢ় আকারের মধ্যে পান, এবং আবশ্যক হইলে কাজে লাগাইতে পারেন, তাহাকেই সত্য বলিয়া জানেন। তাহার বাহিরেও যদি সত্য থাকে, সে সত্যের প্রতি তাঁহার শ্রদ্ধা নাই, এবং সে সত্যের সহিত তিনি কোনো সম্পর্ক রাখিতে চান না। তিনি বলেন, যে-সকল জ্ঞান অত্যাবশ্যক তাহারই ভার বহন করা যথেষ্ট কঠিন। বোঝা ক্রমেই ভারী এবং শিক্ষা ক্রমেই দুঃসাধ্য হইয়া উঠিতেছে। প্রাচীনকালে যখন জ্ঞানবিজ্ঞান এত স্তরে স্তরে জমা হয় নাই, মানুষের নিতান্ত শিক্ষণীয় বিষয় যখন যৎসামান্য ছিল, তখন শৌখিন শিক্ষার অবসর ছিল। কিন্তু এখন আর তো সে অবসর নাই। ছোটো ছেলেকে কেবল বিচিত্র বেশবাস এবং অলংকারে আচ্ছন্ন করিলে কোনো ক্ষতি নাই, তাহার খাইয়া দাইয়া আর কোনো কর্ম নাই। কিন্তু তাই বলিয়া বয়ঃপ্রাপ্ত লোক, যাহাকে করিয়া-কর্মিয়া, নড়িয়া-চড়িয়া, উঠিয়া-হাঁটিয়া ফিরিতে হইবে, তাহাকে পায়ে নূপুর, হাতে কঙ্কণ, শিখায় ময়ূরপুচ্ছ দিয়া সাজাইলে চলিবে কেন? তাহাকে কেবল মালকোঁচা এবং শিরস্ত্রাণ আঁটিয়া দ্রুতপদে অগ্রসর হইতে হইবে। এই কারণে সভ্যতা হইতে প্রতিদিন অলংকার খসিয়া পড়িতেছে। উন্নতির অর্থই এই, ক্রমশ আবশ্যকের সঞ্চয় এবং অনাবশ্যকের পরিহার।
শ্রীমতী অপ্ (ইঁহাকে আমরা স্রোতস্বিনী বলিব) ক্ষিতির এ তর্কের কোনো রীতিমত উত্তর করিতে পারেন না। তিনি কেবল মধুর কাকলি ও সুন্দর ভঙ্গিতে ঘুরিয়া ফিরিয়া বলিতে থাকেন–না, না, ও কথা কখনোই সত্য না। ও আমার মনে লইতেছে না, ও কখনোই সম্পূর্ণ সত্য হইতে পারে না। কেবল বার বার ‘না না, নহে নহে।’ তাহার সহিত আর কোনো যুক্তি নাই; কেবল একটি তরল সংগীতের ধ্বনি, একটি অনুনয়স্বর, একটি তরঙ্গনিন্দিত গ্রীবার আন্দোলন–‘না, না, নহে নহে।’ আমি অনাবশ্যককে ভালোবাসি, অতএব অনাবশ্যকও আবশ্যক। অনাবশ্যক অনেক সময় আমাদের আর কোনো উপকার করে না–কেবলমাত্র আমাদের স্নেহ, আমাদের ভালোবাসা, আমাদের করুণা, আমাদের স্বার্থবিসর্জনের স্পৃহা উদ্রেক করে; পৃথিবীতে সেই ভালোবাসার আবশ্যকতা কি নাই? শ্রীমতী স্রোতস্বিনীর এই অনুনয় প্রবাহে শ্রীযুক্ত ক্ষিতি প্রায় গলিয়া যান, কিন্তু কোনো যুক্তির দ্বারা তাঁহাকে পরাস্ত করিবার সাধ্য কী।
শ্রীমতী তেজ (ইঁহাকে দীপ্তি নাম দেওয়া গেল) একেবারে নিষ্কাষিত অসিলতার মতো ঝিক্মিক্ করিয়া উঠেন এবং শাণিত সুন্দর সুরে ক্ষিতিকে বলেন–ইস! তোমরা মনে কর পৃথিবীতে কাজ তোমরা কেবল একলাই কর। তোমাদের কাজে যাহা আবশ্যক নয় বলিয়া ছাঁটিয়া ফেলিতে চাও, আমাদের কাজে তাহা আবশ্যক হইতে পারে। তোমাদের আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা, বিশ্বাস, শিক্ষা এবং শরীর হইতে অলংকারমাত্রই তোমরা ফেলিয়া দিতে চাও, কেননা, সভ্যতার ঠেলাঠেলিতে স্থান এবং সময়ের বড়ো অনটন হইয়াছে। কিন্তু আমাদের যাহা চিরন্তন কাজ, ঐ অলংকারগুলো ফেলিয়া দিলে তাহা একপ্রকার বন্ধ হইয়া যায়। আমাদের কত