আমি কহিলাম–কিন্তু তবু চিরকাল মানুষ এই-সমস্ত ওজনে-ভারী মোটা জিনিসকে একেবারে অস্বীকার করিতে চেষ্টা করিতেছে। ধূলিকে আবৃত করে, স্বার্থকে লজ্জা দেয়, ক্ষুধাকে অন্তরালে নির্বাসিত করিয়া রাখে। মলিনতা পৃথিবীতে বহুকালের আদিম সৃষ্টি; ধূলিজঞ্জালের অপেক্ষা প্রাচীন পদার্থ মেলাই কঠিন; তাই বলিয়া সেইটেই সব চেয়ে সত্য হইল, আর অন্তর-অন্তঃপুরের যে লক্ষ্মীরূপিণী গৃহিণী আসিয়া তাহাকে ক্রমাগত ধৌত করিতে চেষ্টা করিতেছে তাহাকেই কি মিথ্যা বলিয়া উড়াইয়া দিতে হইবে?
ক্ষিতি কহিল–তোমরা ভাই এত ভয় পাইতেছ কেন? আমি তোমাদের সেই অন্তঃপুরের ভিত্তিতলে ডাইনামাইট লাগাইতে আসি নাই। কিন্তু একটু ঠাণ্ডা হইয়া বলো দেখি, পুণ্যাহের দিন ঐ বেসুরো সানাইটা বাজাইয়া পৃথিবীর কী সংশোধন করা হয়? সংগীতকলা তো নহেই।
সমীর কহিল–ও আর কিছুই নহে একটা সুর ধরাইয়া দেওয়া। সংবৎসরের বিবিধ পদস্খলন এবং ছন্দঃপতনের পর পুনর্বার সমের কাছে আসিয়া একবার ধুয়ায় আনিয়া ফেলা। সংসারের স্বার্থকোলাহলের মাঝে মাঝে একটা পঞ্চম সুর সংযোগ করিয়া দিলে নিদেন ক্ষণকালের জন্য পৃথিবীর শ্রী ফিরিয়া যায়, হঠাৎ হাটের মধ্যে গৃহের শোভা আসিয়া আবির্ভূত হয়, কেনাবেচার উপর ভালোবাসার স্নিগ্ধ দৃষ্টি চন্দ্রালোকের ন্যায় নিপতিত হইয়া তাহার শুষ্ক কঠোরতা দূর করিয়া দেয়। যাহা হইয়া থাকে পৃথিবীতে তাহা চীৎকার-স্বরে হইতেছে, আর, যাহা হওয়া উচিত তাহা মাঝে মাঝে এক-একদিন আসিয়া মাঝখানে বসিয়া সুকোমল সুন্দর সুরে সুর দিতেছে, এবং তখনকার মতো সমস্ত চীৎকারস্বর নরম হইয়া আসিয়া সেই সুরের সহিত আপনাকে মিলাইয়া লইতেছে–পুণ্যাহ সেই সংগীতের দিন।
আমি কহিলাম–উৎসবমাত্রই তাই। মানুষ প্রতিদিন যে ভাবে কাজ করে এক-একদিন তাহার উল্টা ভাবে আপনাকে সারিয়া লইতে চেষ্টা করে। প্রতিদিন উপার্জন করে, একদিন খরচ করে; প্রতিদিন দ্বার রুদ্ধ করিয়া রাখে, একদিন দ্বার উন্মুক্ত করিয়া দেয়; প্রতিদিন গৃহের মধ্যে আমিই গৃহকর্তা, আর-একদিন আমি সকলের সেবায় নিযুক্ত। সেইদিন শুভদিন, আনন্দের দিন, সেইদিনই উৎসব। সেই দিন সম্বৎসরের আদর্শ। সেদিন ফুলের মালা, স্ফটিকের প্রদীপ, শোভন ভূষণ এবং দূরে একটি বাঁশি বাজাইয়া বলিতে থাকে, আজিকার এই সুরই যথার্থ সুর, আর-সমস্তই বেসুরা। বুঝিতে পারি, আমরা মানুষে মানুষে হৃদয়ে হৃদয়ে মিলিত হইয়া আনন্দ করিতে আসিয়াছিলাম, কিন্তু প্রতিদিনের দৈন্যবশত তাহা পারিয়া উঠি না; যেদিন পারি সেইদিনই প্রধান দিন।
সমীর কহিল–সংসারে দৈন্যের শেষ নাই। সে দিক হইতে দেখিতে গেলে মানব-জীবনটা অত্যন্ত শীর্ণ শূন্য শ্রীহীন রূপে চক্ষে পড়ে। মানবাত্মা জিনিসটা যতই উচ্চ হউক-না কেন, দুইবেলা দুইমুষ্টি তণ্ডুল সংগ্রহ করিতেই হইবে, একখণ্ড বস্ত্র না হইলে সে মাটিতে মিশাইয়া যায়। এ দিকে আপনাকে অবিনাশী অনন্ত বলিয়া বিশ্বাস করে, ও দিকে যেদিন নস্যের ডিবাটা হারাইয়া যায় সেদিন আকাশ বিদীর্ণ করিয়া ফেলে। যেমন করিয়াই হোক, প্রতিদিন তাহাকে আহার-বিহার কেনা-বেচা দর-দাম মারামারি ঠেলাঠেলি করিতেই হয়–সেজন্য সে লজ্জিত। এই কারণে সে এই শুষ্ক ধূলিময় লোকাকীর্ণ হাট-বাজারের ইতরতা ঢাকিবার জন্য সর্বদা প্রয়াস পায়। আহারে-বিহারে আদানে-প্রদানে আত্মা আপনার সৌন্দর্যবিভা বিস্তার করিবার চেষ্টা করিতে থাকে। সে আপনার আবশ্যকের সহিত আপনার মহত্ত্বের সুন্দর সামঞ্জস্য সাধন করিয়া লইতে চায়।
আমি কহিলাম–তাহারই প্রমাণ এই পুণ্যাহের বাঁশি। একজনের ভূমি, আর-একজন তাহারই মূল্য দিতেছে, এই শুষ্ক চুক্তির মধ্যে লজ্জিত মানবাত্মা একটি ভাবের সৌন্দর্য প্রয়োগ করিতে চাহে। উভয়ের মধ্যে একটি আত্মীয়সম্পর্ক বাঁধিয়া দিতে ইচ্ছা করে। বুঝাইতে চাহে ইহা চুক্তি নহে, ইহার মধ্যে একটি প্রেমের স্বাধীনতা আছে। রাজাপ্রজা ভাবের সম্বন্ধ, আদানপ্রদান হৃদয়ের কর্তব্য। খাজনার টাকার সহিত রাগরাগিণীর কোনো যোগ নাই, খাজাঞ্চিখানা নহবত বাজাইবার স্থান নহে, কিন্তু যেখানেই ভাবের সম্পর্ক আসিয়া দাঁড়াইল–অমনি সেখানেই বাঁশি তাহাকে আহ্বান করে, রাগিণী তাহাকে প্রকাশ করে, সৌন্দর্য তাহার সহচর। গ্রামের বাঁশি