Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://xn--u5bxfcqewdax4kraj7ob.xn--45brj9c)


কৃষ্ণচরিত্র-৪
কৃষ্ণচরিত্র
অত্যল্পমাত্রে পরিতৃপ্ত হওয়ায় সহজেই সন্তুষ্ট হইতে থাকে। চিরকাল ধূমিত হওয়া অপেক্ষা মুহূর্তকাল জ্বলিত হওয়াও শতগুণে শ্রেষ্ঠ। ... ইহসংসারে প্রজ্ঞাবান্‌ পুরুষ অত্যল্প বস্তুকে অপ্রিয় বোধ করেন; অত্যল্প বস্তু যাহার প্রিয় হয়, তাহার সেই অল্প বস্তুই নিশ্চয় অনিষ্টকর হইয়া থাকে। ... যাহারা ফলের অনিত্যত্ব স্থির করিয়াও কর্মের অনুষ্ঠানে পরাঙ্‌মুখ না হয় তাহাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হইতেও পারে, না হইতেও পারে; কিন্তু অনিশ্চিত বোধে যাহারা একেবারেই অনুষ্ঠানে বিরত হয় তাহারা আর কস্মিন্‌কালেও কৃতকার্য হইতে পারে না।’

ইহা হইতে এই দেখা যাইতেছে যে, কর্তব্যপরায়ণতা সম্বন্ধে মহাভারতের কবিত্ব আদর্শ অত্যন্ত উচ্চ ছিল, এবং সেই আদর্শ তিনি নানা উদাহরণের দ্বারা নানা স্থানে প্রচার করিয়াছেন। মহাভারত ভালো করিয়া পর্যালোচনা করিয়া দেখিলে এমন কল্পনা করাও অসংগত হয় না যে, এক সময়ে ভারতে কর্মধর্মের শ্রেষ্ঠতা ঘোষণার উদ্দেশে কবি লোকবিখ্যাত কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধবৃত্তান্ত মহাকাব্যে গ্রথিত করিয়াছেন। কৃষ্ণ, অর্জুন, ভীষ্ম, কর্ণ, দ্রোণ প্রভৃতি মহাভারতের প্রধান নায়কগুলিমাত্রেই কর্মবীরের শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্তস্থল; এমন-কী, গান্ধারী এবং দ্রৌপদীও কর্তব্যনিষ্ঠার মহিমায় দীপ্তিমতী। সেইজন্য গান্ধারী দুর্যোধনকে ত্যাগ করিবার প্রস্তাব করিয়াছিলেন এবং দ্রৌপদী বলিয়াছিলেন, ‘অবধ্য ব্যক্তিকে বধ করিলে যে পাপ হয়, বধ্য ব্যক্তিকে বধ না করিলেও সেই পাপ হইয়া থাকে।’

অতএব বঙ্কিম যাহা বলিতেছেন তাহাতে যদি প্রমাণের কোনো ত্রুটি না থাকে তবে তদ্‌দ্বারা ইহাই স্থির হইয়াছে যে, কোনো-একটি অজ্ঞাতনামা কবির মনে মহত্ত্বের আদর্শ অতি উচ্চ ছিল; এবং তাঁহার সেই উচ্চতম আদর্শ-সৃষ্টিই মহাভারতের কৃষ্ণ। কৃষ্ণ ঐতিহাসিক হইতে পারেন কিন্তু মহাভারতের কৃষ্ণ যে সর্বাংশে ঐতিহাসিক কৃষ্ণের প্রতিরূপ তাহার কোনো প্রমাণ নাই। ইহাও দেখা যাইতেছে যে, এই মহাভারতেই ভিন্ন লোক ভিন্ন আদর্শের কৃষ্ণ সংগঠন করিয়াছেন।

যেখানে এক সাক্ষী বিরোধী কথা কহিতেছে সেখানে অন্যান্য সাক্ষী ডাকিয়া সত্য সংগ্রহ করিতে হয়। কিন্তু বঙ্কিমবাবু দেখাইয়াছেন, মহাভারতে কৃষ্ণের জীবনের যে অংশ বর্ণিত হইয়াছে অন্য কোনো পুরাণেই তাহা হয় নাই; সুতরাং ভিন্ন ভিন্ন সাক্ষীর সাক্ষ্য তুলনা করিয়া সত্য উদ্ধারের যে উপায় আছে, এ স্থলে তাহাও নাই।

অতএব বঙ্কিমবাবুর প্রমাণমতে দেখিতে পাইতেছি, ব্যাসরচিত মূল মহাভারত বর্তমান নাই। এখন যে মহাভারত পাওয়া যায় তাহা ব্যাসের মুখ হইতে বৈশম্পায়ন, বৈশম্পায়নের মুখ হইতে উগ্রশ্রবার পিতা, পিতার মুখ হইতে উগ্রশ্রবা, এবং উগ্রশ্রবার মুখ হইতে অন্য কোনো-একজন কবি সংগ্রহ করিয়াছেন। দ্বিতীয়ত, এ মহাভারতের মধ্যেও কালক্রমে নানা লোকের রচনা মিশ্রিত হইয়াছে; তাহা নিঃসংশয়ে বিশ্লিষ্ট করিবার কোনো নির্ভরযোগ্য উপায় আপাতত স্থির হয় নাই। তৃতীয়ত, অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থ হইতে তুলনা-দ্বারা মহাভারতের ঐতিহাসিকতা প্রমাণ করিবারও পথ নাই।

বঙ্কিম প্রধানত কৃষ্ণচরিত্রকেই উপলক্ষ করিয়া কেবল প্রসঙ্গক্রমে মহাভারতের ঐতিহাসিকতা বিচার করিয়াছেন; কিন্তু প্রথমে প্রমাণ ও বিচার প্রয়োগপূর্বক প্রধানত সমস্ত মহাভারতের ইতিহাস-অংশ বাহির করিলে পর, তবে কৃষ্ণচরিত্রের ঐতিহাসিকতা সন্তোষজনকরূপে প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে।

উদাহরণস্বরূপে বলিতে পারি, দ্রৌপদীর পঞ্চপতিগ্রহণ প্রামাণিক সত্য কি না, সে বিষয়ে বঙ্কিম সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছেন; অতএব দেখা আবশ্যক, বঙ্কিম যাহাকে মূল মহাভারত বলিতেছেন তাহার সর্বত্র হইতেই দ্রৌপদীর পঞ্চপতিগ্রহণ বর্জন করা যায় কি না, এবং বঙ্কিম মহাভারতের যে যে অংশ হইতে কৃষ্ণচরিত্রের ইতিহাস সংকলন করিয়াছেন, সেই সেই অংশে দ্রৌপদীর পঞ্চপতিচর্যা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত নাই কি না। বঙ্কিম মহাভারতবর্ণিত যে-সকল ঘটনাকে অনৈতিহাসিক মনে করেন সে-সমস্ত যদি তিনি তাঁহার কল্পিত মূল মহাভারত হইতে প্রমাণসহকারে দূর করিয়া দিতে পারেন তবে আমরা তাঁহার নির্বাচিত অংশকে বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাসরূপে গ্রহণ করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে পারি। কিন্তু মহাভারতের ঠিক কতটুকু মূল ঐতিহাসিক অংশ তাহা বঙ্কিম সুস্পষ্টরূপে নির্দিষ্ট করেন নাই, তিনি কেবলমাত্র কৃষ্ণচরিত্রের ধারাটি অনুসরণ করিয়া গিয়াছেন। তিনি এক স্থানে বলিয়াছেন–