স্রোতস্বিনী কহিল–রাত্রে ইঁদুরে তাহা কুটি কুটি করিয়া কাটিয়া পিয়ানোর তারের মধ্যে ছড়াইয়া রাখিয়াছে। এরূপ অনাবশ্যক ক্ষতি করিবার তো কোনো উদ্দেশ্য খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।
সমীর কহিল–উক্ত ইন্দুরটি বোধ করি ইন্দুরবংশে একটি বিশেষক্ষমতাসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক; বিস্তর গবেষণায় সে বাজনার বহির সহিত বাজনার তারের একটা সম্বন্ধ অনুমান করিতে পারিয়াছে। এখন সমস্ত রাত ধরিয়া পরীক্ষা চালাইতেছে। বিচিত্র ঐকতানপূর্ণ সংগীতের আশ্চর্য রহস্য ভেদ করিবার চেষ্টা করিতেছে। তীক্ষ্ণ দন্তাগ্রভাগ-দ্বারা বাজনার বহির ক্রমাগত বিশ্লেষণ করিতেছে, পিয়ানোর তারের সহিত তাহাকে নানাভাবে একত্র করিয়া দেখিতেছে। এখন বাজনার বই কাটিতে শুরু করিয়াছে, ক্রমে বাজনার তার কাটিবে, কাঠ কাটিবে, বাজনাটাকে শতছিদ্র করিয়া সেই ছিদ্রপথে আপন সূক্ষ্ম নাসিকা ও চঞ্চল কৌতূহল প্রবেশ করাইয়া দিবে–মাঝে হইতে সংগীতও ততই উত্তরোত্তর সুদূরপরাহত হইবে। আমার মনে এই তর্ক উদয় হইতেছে যে, ইন্দুরকুলতিলক যে উপায় অবলম্বন করিয়াছে তাহাতে তার এবং কাগজের উপাদান সম্বন্ধে নূতন তত্ত্ব আবিষ্কৃত হইতে পারে, কিন্তু উক্ত কাগজের সহিত উক্ত তারের যথার্থ যে সম্বন্ধ তাহা কি শতসহস্র বৎসরেও বাহির হইবে। অবশেষে কি সংশয়পরায়ণ নব্য ইন্দুরদিগের মনে এইরূপ একটা বিতর্ক উপস্থিত হইবে না যে, কাগজ কেবল কাগজ মাত্র, এবং তার কেবল তার–কোনো জ্ঞানবান্ জীব-কর্তৃক উহাদের মধ্যে যে একটা আনন্দজনক উদ্দেশ্যবন্ধন বদ্ধ হইয়াছে তাহা কেবল প্রাচীন ইন্দুরদিগের যুক্তিহীন সংস্কার, সেই সংস্কারের কেবল একটা এই শুভফল দেখা যাইতেছে যে তাহারই প্রবর্তনায় অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়া তার এবং কাগজের আপেক্ষিক কঠিনতা সম্বন্ধে অনেক পরীক্ষা সম্পন্ন হইয়াছে। কিন্তু এক-একদিন গহ্বরের গভীরতলে দন্তচালনকার্যে নিযুক্ত থাকিয়া মাঝে মাঝে অপূর্ব সংগীতধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবেশ করে এবং অন্তঃকরণকে ক্ষণকালের জন্য মোহাবিষ্ট করিয়া দেয়। সেটা ব্যাপারটা কী? সে একটা রহস্য বটে। কিন্তু সে রহস্য নিশ্চয়ই কাগজ এবং তার সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিতে করিতে ক্রমশ শতছিদ্র আকারে উদ্ঘাটিত হইয়া যাইবে।