Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://xn--u5bxfcqewdax4kraj7ob.xn--45brj9c)


আত্মপরিচয়- ৩, ১৮
আত্মপরিচয় ৩

সেই তো তোমার গেহ।

সমরঘাতে অমর করে নিঠুর স্নেহ

সেই তো তোমার স্নেহ।

সব ফুরালে বাকি রহে অদৃশ্য যেই দান

সেই তো তোমার দান।

মৃত্যু আপন পাত্র ভরি বহিছে যেই প্রাণ

সেই তো তোমার প্রাণ।

বিশ্বজনের পায়ের তলে ধূলিময় যে ভূমি

সেই তো তোমার ভূমি।

সবায় নিয়ে সবার মাঝে লুকিয়ে আছ তুমি

সেই তো আমার তুমি॥

সত্যং জ্ঞানম্‌ অনন্তম্‌। শান্তং শিবম্‌ অদ্বৈতম্‌। ইহুদী পুরাণে আছে — মানুষ একদিন অমৃতলোকে বাস করত। সে লোক স্বর্গলোক। সেখানে দুঃখ নেই, মৃত্যু নেই। কিন্তু যে স্বর্গকে দুঃখের ভিতর দিয়ে, মন্দের সংঘাত দিয়ে, না জয় করতে পেরেছি সে স্বর্গ তো জ্ঞানের স্বর্গ নয় — তাকে স্বর্গ বলে জানিই নে। মায়ের গর্ভের মধ্যে মাকে পাওয়া যেমন মাকে পাওয়াই নয়, তাঁকে বিচ্ছেদের মধ্যে পাওয়াই পাওয়া।

গর্ভ ছেড়ে মাটির'পরে

যখন পড়ে,

তখন ছেলে দেখে আপন মাকে।

তোমার আদর যখন ঢাকে

জড়িয়ে থাকি তারি নাড়ীর পাকে,

তখন তোমায় নাহি জানি।

আঘাত হানি

তোমারি আচ্ছাদন হতে যেদিন দূরে ফেলাও টানি

সে বিচ্ছেদে চেতনা দেয় আনি —

দেখি বদনখানি।

তাই সেই অচেতন স্বর্গলোকে জ্ঞান এল। সেই জ্ঞান আসতেই সত্যের মধ্যে আত্মবিচ্ছেদ ঘটল। সত্যমিথ্যা-ভালোমন্দ-জীবনমৃত্যুর দ্বন্দ্ব এসে স্বর্গ থেকে মানুষকে লজ্জা-দুঃখ-বেদনার মধ্যে নির্বাসিত করে দিলে। এই দ্বন্দ্ব অতিক্রম করে যে অখণ্ড সত্যে মানুষ আবার ফিরে আসে তার থেকে তার আর বিচ্যুতি নেই। কিন্তু এই-সমস্ত বিপরীতের বিরোধ মিটতে পারে কোথায়? অনন্তের মধ্যে। তাই উপনিষদে আছে, সত্যং জ্ঞানম্‌ অনন্তম্‌। প্রথমে সত্যের মধ্যে জড় জীব সকলেরই সঙ্গে এক হয়ে মানুষ বাস করে — জ্ঞান এসে বিরোধ ঘটিয়ে মানুষকে সেখান থেকে টেনে স্বতন্ত্র করে — অবশেষে সত্যের পরিপূর্ণ অনন্ত রূপের ক্ষেত্রে আবার তাকে সকলের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়। ধর্মবোধের প্রথম অবস্থায় শান্তম্‌, মানুষ তখন আপন প্রকৃতির অধীন — তখন সে সুখকেই চায়, সম্পদকেই চায়, তখন শিশুর মতো কেবল তার রসভোগের তৃষ্ণা, তখন তার লক্ষ্য প্রেয়। তার পরে মনুষ্যত্বের উদ্‌বোধনের