লোকেশ্বরী। ওই রূপ নিয়ে তার মাকে সে লজ্জা দিয়ে গেল! যে মায়ের প্রাণ আমার নাড়ীতে, যে মায়ের স্নেহ আমার হৃদয়ে, তাকে ঐ রূপ ধিক্কার দিলে। যে-জন্ম তাকে দিয়েছি আমি, সেজন্মের সঙ্গে তার এজন্মের কেবল যে বিচ্ছেদ তা নয়, বিরোধ। দেখ্ মল্লিকা আজ খুব স্পষ্ট করে বুঝতে পারলেম এ ধর্ম পুরুষের তৈরি। এ ধর্মে মা ছেলের পক্ষে অনাবশ্যক; স্ত্রীকে স্বামীর প্রয়োজন নেই। যারা না পুত্র, না স্বামী, না ভাই, সেই-সব ঘরছাড়াদের একটুখানি ভিক্ষা দেবার জন্যে সমস্ত প্রাণকে শুকিয়ে ফেলে আমরা শুন্য ঘরে পড়ে থাকব! মল্লিকা, এই পুরুষের ধর্ম আমাদের মেরেছে, আমরাও একে মারব।
মল্লিকা। কিন্তু দেবী, দেখনি? মেয়েরাই যে দলে দলে চলেছে বুদ্ধকে পূজা দেবার জন্যে।
লোকেশ্বরী। মূঢ় ওরা, ভক্তি করবার ক্ষুধার ওদের অন্ত নেই। যা ওদের সব চেয়ে মারে তাকেই ওরা সব চেয়ে বেশি করে দেয়। এই মোহকে আমি প্রশ্রয় দিইনে।
মল্লিকা। মুখে বলছ মহারানী, নিশ্চয় জানি, তোমার ওই পুত্র আজ তোমার সেবাকক্ষের দ্বার দিয়ে বেরিয়ে এসে তোমার পূজাকক্ষের দ্বার দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেছে। তোমার মানব-পুত্র কোল থেকে নেমে আজ দেবতা-পুত্র হয়ে তোমার হৃদয়ের পূজাবেদীতে চড়ে বসেছে।
লোকেশ্বরী। চুপ চুপ! বলিসনে! আমি হাত জোড় করে তাকে অনুরোধ করলেম; বললেম, ‘একরাত্রির জন্যে তোমার মাতার ঘরে থেকে যাও’। সে বললে, “আমার মাতার ঘরের উপরে ছাদ নেই— আছে আকাশ।” মল্লিকা, যদি মা হতিস তো বুঝতিস কতবড়ো কঠিন কথা! বজ্র দেবতার হাতের কিন্তু সে তো বজ্র। বুক বিদীর্ণ হয়ে যায় নি! সেই বিদীর্ণ বুকের ছিদ্রের ভিতর দিয়ে ঐ-যে রাস্তার শ্রমণদের গর্জন আমার পাঁজরগুলোর ভিতরে প্রতিধ্বনিত হয়ে বেড়াচ্ছে— বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি, ধম্মং সরণং গচ্ছামি, সংঘং সরণং গচ্ছামি।
মল্লিকা। একি মহারানী, মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আজো আপনি যে নমস্কার করেন!
লোকেশ্বরী। ওই তো বিপদ। মল্লিকা, দুর্বলের ধর্ম মানুষকে দুর্বল করে। দুর্বল করাই এই ধর্মের উদ্দেশ্য। যত উঁচু মাথাকে সব হেঁট করে দেবে। ব্রাহ্মণকে বলবে সেবা করো, ক্ষত্রিয়কে বলবে ভিক্ষা করো। এই ধর্মের বিষ অনেকদিন স্বেচ্ছায় নিজের রক্তের মধ্যে পালন করেছি। সেইজন্যে আজ আমিই একে সব চেয়ে ভয় করি। ঐ কে আসছে?
মল্লিকা। রাজকুমারী বাসবী। পূজাস্থলে যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে এসেছেন।
বাসবীর প্রবেশ
লোকেশ্বরী। পূজায় চলেছ?
বাসবী। হাঁ।
লোকেশ্বরী। তোমাদের তো বয়স হয়েছে?
বাসবী। আমাদের ব্যবহারে তার কি কোনো বৈলক্ষণ্য দেখছেন?
লোকেশ্বরী। শিশু! তোমরা নাকি বলে বেড়াচ্ছ, অহিংসা পরমো ধর্মঃ!
বাসবী। আমাদের চেয়ে যাঁদের বয়স অনেক বেশি তাঁরাই বলে বেড়াচ্ছেন, আমরা তো কেবল মুখে আবৃত্তি করি মাত্র।
লোকেশ্বরী। নির্বোধকে কেমন করে বোঝাব অহিংসা ইতরের ধর্ম! হিংসা ক্ষত্রিয়ের বিশাল বাহুতে মাণিক্যের অঙ্গদ, নিষ্ঠুর তেজে দীপ্যমান।
বাসবী। শক্তির কি কোমল রূপ নেই?