একটা কথা আমাদিগকে ভালো করিয়া বুঝিতে হইবে যে, পরের প্রদত্ত অধিকার আমাদের জাতীয় সম্পদ্রূপে গণ্য হইতে পারে না—বরঞ্চ তাহার বিপরীত। দৃষ্টান্তস্বরূপে একবার পঞ্চায়েৎবিধির কথা ভাবিয়া দেখুন। একসময় পঞ্চায়েৎ আমাদের দেশের জিনিস ছিল, এখন পঞ্চায়েৎ গবর্মেন্টের আফিসে-গড়া জিনিস হইতে চলিল। যদি ফল বিচার করা যায় তবে এই দুই পঞ্চায়েতের প্রকৃতি একেবারে পরস্পরের বিপরীত বলিয়াই প্রতীত হইবে। যে পঞ্চায়েতের ক্ষমতা গ্রামের লোকের স্বতঃপ্রদত্ত নহে, যাহা গবর্মেন্টের দত্ত, তাহা বাহিরের জিনিস হওয়াতেই গ্রামের বক্ষে একটা অশান্তির মতো চাপিয়া বসিবে—তাহা ঈর্ষার সৃষ্টি করিবে—এই পঞ্চায়েৎপদ লাভ করিবার জন্য অযোগ্য লোকে এমন-সকল চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইবে যাহাতে বিরোধ জন্মিতে থাকিবে—পঞ্চায়েৎ ম্যাজিস্ট্রেটবর্গকেই স্বপক্ষ এবং গ্রামকে অপর পক্ষ বলিয়া জানিবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট বাহবা পাইবার জন্য গোপনে অথবা প্রকাশ্যে গ্রামের বিশ্বাসভঙ্গ করিবে—ইহারা গ্রামের লোক হইয়া গ্রামের চরের কাজ করিতে বাধ্য হইবে এবং যে পঞ্চায়েৎ এ দেশে গ্রামের বলস্বরূপ ছিল সেই পঞ্চায়েৎই গ্রামের দুর্বলতার কারণ হইবে। ভারতবর্ষের যে-সকল গ্রামে এখনো গ্রাম্য পঞ্চায়েতের প্রভাব বর্তমান আছে, যে পঞ্চায়েৎ কালক্রমে শিক্ষার বিস্তার ও অবস্থার পরিবর্তন-অনুসারে স্বভাবতই স্বাদেশিক পঞ্চায়েতে পরিণত হইতে পারিত, যে-গ্রাম্যপঞ্চায়েৎগণ একদিন স্বদেশের সাধারণ কার্যে পরস্পরের মধ্যে যোগ বাঁধিয়া দাঁড়াইবে এমন আশা করা যাইত—সেই-সকল গ্রামের পঞ্চায়েৎগণের মধ্যে একবার যদি গবর্মেন্টের বেনো জল প্রবেশ করে, তবে পঞ্চায়েতের পঞ্চায়েতত্ব চিরদিনের মতো ঘুচিল। দেশের জিনিস হইয়া তাহারা যে কাজ করিত গবর্মেন্টের জিনিস হইয়া তাহার সম্পূর্ণ উলটারকম কাজ করিবে।
ইহা হইতে আমাদিগকে বুঝিতে হইবে, দেশের হাত হইতে আমরা যে ক্ষমতা পাই তাহার প্রকৃতি একরকম, আর পরের হাত হইতে যাহা পাই তাহার প্রকৃতি সম্পূর্ণ অন্যরকম হইবেই। কারণ, মূল্য না দিয়া কোনো জিনিস আমরা পাইতেই পারি না। সুতরাং দেশের কাছ হইতে আমরা যাহা পাইব সেজন্য দেশের কাছেই আপনাকে বিকাইতে হইবে—পরের কাছ হইতে যাহা পাইব সেজন্য পরের কাছে না বিকাইয়া উপায় নাই। এইরূপ বিদ্যাশিক্ষার সুযোগ যদি পরের কাছে মাগিয়া লইতে হয় তবে শিক্ষাকে পরের গোলামি করিতেই হইবে—যাহা স্বাভাবিক, তাহার জন্য আমরা বৃথা চীৎকার করিয়া মরি কেন?
দৃষ্টান্তস্বরূপ আর-একটা কথা বলি। মহাজনেরা চাষিদের অধিক সুদে কর্জ দিয়া তাহাদের সর্বনাশ করিতেছে, আমরা প্রার্থনা ছাড়া অন্য উপায় জানি না—অতএব গবর্মেন্টকেই অথবা বিদেশী মহাজনদিগকে যদি আমরা বলি যে, তোমরা অল্প সুদে আমাদের গ্রামে গ্রামে কৃষি-ব্যাঙ্ক স্থাপন করো, তবে নিজে খদ্দের ডাকিয়া আনিয়া আমাদের দেশের চাষিদিগকে নিঃশেষে পরের হাতে বিকাইয়া দেওয়া হয় না? যাহারা যথার্থই দেশের বল, দেশের সম্পদ, তাহাদের প্রত্যেকটিতে কি পরের হাতে এমনি করিয়া বাঁধা রাখিতে হইবে? আমরা যে পরিমাণেই দেশের কাজ পরকে দিয়া করাইব সেই পরিমাণেই আমরা নিজের শক্তিকেই বিকাইতে থাকিব, দেশকে স্বেচ্ছাকৃত অধীনতাপাশে উত্তরোত্তর অধিকতর বাঁধিতে থাকিব—এ কথা কি বুঝা এতই কঠিন? পরের প্রদত্ত ক্ষমতা আমাদের পক্ষে উপস্থিত সুবিধার কারণ যেমনই হউক তাহা আমাদের পক্ষে ছদ্মবেশী অভিসম্পাত, এ কথা স্বীকার করিতে আমাদের যত বিলম্ব হইবে আমাদের মোহজাল ততই দুশ্ছেদ্য হইয়া উঠিতে থাকিবে।
অতএব, আর দ্বিধা না করিয়া আমাদের গ্রামের স্বকীয় শাসনকার্য আমাদিগকে নিজের হাতে লইতেই হইবে। সরকারি পঞ্চায়েতের মুষ্টি আমাদের পল্লীর কণ্ঠে দৃঢ় হইবার পূর্বেই আমাদের নিজের পল্লী-পঞ্চায়েৎকে জাগাইয়া তুলিতে হইবে। চাষিকে আমরাই রক্ষা করিব, তাহার সন্তানদিগকে আমরাই শিক্ষা দিব, কৃষির উন্নতি আমরাই সাধন করিব, গ্রামের স্বাস্থ্য আমরাই বিধান করিব এবং সর্বনেশে মামলার হাত হইতে আমাদের জমিদার ও প্রজাদিগকে আমরাই বাঁচাইব। এ সম্বন্ধে রাজার সাহায্য লইবার কল্পনাও যেন আমাদের মাথায় না আসে-কারণ, এ স্থলে সাহায্য লইবার অর্থই দুর্বলের স্বাধীন অধিকারের মধ্যে প্রবলকে ডাকিয়া