
পৃথিবীর পূর্বকোণের লোক, অর্থাৎ আমরা, অত্যুক্তি অত্যন্ত ব্যবহার করিয়া থাকি; আমাদের পশ্চিমের গুরুমশায়দের কাছ হইতে ইহা লইয়া আমরা প্রায় বকুনি খাই। যাঁহারা সাত সমুদ্র পার হইয়া আমাদের ভালোর জন্য উপদেশ দিতে আসেন তাঁহাদের কথা আমাদের নতশিরে শোনা উচিত। কারণ, তাঁহারা যে হতভাগ্য আমাদের মতো কেবল কথাই বলিতে জানেন তাহা নহে, কথা যে কী করিয়া শোনাইতে হয় তাহাও তাঁহাদের অবিদিত নাই। আমাদের দুটো কানের উপরেই তাঁহাদের দখল সম্পূর্ণ।
আচারে উক্তিতে আতিশয্য ভালো নহে, বাক্যে ব্যবহারে সংযম আবশ্যক, এ কথা আমাদের শাস্ত্রেও বলে। তাহার ফল যে ফলে নাই তাহা বলিতে পারি না। ইংরেজের পক্ষে আমাদের দেশ শাসন সহজ হইত না, যদি আমরা গুরুর উপদেশ না মানিতাম। ঘরে বাহিরে এত দিনের শাসনের পরেও যদি আমাদের উক্তিতে কিছু পরিমাণাধিক্য থাকে তবে ইহা নিশ্চয়, সেই অত্যুক্তি অপরাধের নহে, তাহা আমাদের একটা বিলাসমাত্র।
আসল কথা, সকল জাতির মধ্যেই অত্যুক্তি ও আতিশয্য আছে। নিজেরটাকেই অত্যন্ত স্বাভাবিক ও পরেরটাকেই অত্যন্ত অসংগত বোধ হয়। যে প্রসঙ্গে আমাদের কথা আপনি বাড়িয়া চলে সে প্রসঙ্গে ইংরেজ চুপ, যে প্রসঙ্গে ইংরেজ অত্যন্ত বেশি বকিয়া থাকে সে প্রসঙ্গে আমাদের মুখে কথা বাহির হয় না। আমরা মনে করি ইংরেজ বড়ো বাড়াবাড়ি করে, ইংরেজ মনে করে প্রাচ্যলোকের পরিমাণ-বোধ নাই।
আমাদের দেশে গৃহস্থ অতিথিকে সম্বোধন করিয়া বলে,’সমস্ত আপনারই–আপনারই ঘর, আপনারই বাড়ি।’ইহা অত্যুক্তি। ইংরেজ তাহার নিজের রান্নাঘরে প্রবেশ করিতে হইলে রাঁধুনিকে জিজ্ঞাসা করে,’ঘরে ঢুকিতে পারি কি?’এ এক রকমের অত্যুক্তি।
স্ত্রী নুনের বাটি সরাইয়া দিলে ইংরেজ স্বামী বলে,’আমার ধন্যবাদ জানিবে।’ইহা অত্যুক্তি। নিমন্ত্রণকারীর ঘরে চর্বচোষ্য খাইয়া এবং বাঁধিয়া এ-দেশীয় নিমন্ত্রিত বলে’বড়ো পরিতোষ লাভ করিলাম’, অর্থাৎ’আমার পরিতোষই তোমার পারিতোষিক’, তদুত্তরে নিমন্ত্রণকারী বলে’আমি কৃতার্থ হইলাম’–ইহাকে অত্যুক্তি বলিতে পারো।
আমাদের দেশে স্ত্রী স্বামীকে পত্রে’শ্রীচরণেষু’পাঠ লিখিয়া থাকে, ইংরেজের কাছে ইহা অত্যুক্তি। ইংরেজ যাহাকে তাহাকে পত্রে’প্রিয়’সম্বোধন করে–অভ্যস্ত না হইয়া গেলে ইহা আমাদের কাছে অত্যুক্তি বলিয়া ঠেকিত।
নিশ্চয়ই আরো এমন সহস্র দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু এগুলি বাঁধা অত্যুক্তি, ইহারা পৈতৃক। দৈনিক ব্যবহারে আমরা নব নব অত্যুক্তি রচনা করিয়া থাকি, ইহাই প্রাচ্যজাতির প্রতি ভর্ৎসনার কারণ।
তালি এক হাতে বাজে না, তেমনি কথা দুজনে মিলিয়া হয়। শ্রোতা ও বক্তা যেখানে পরস্পরের ভাষা বোঝে সেখানে অত্যুক্তি উভয়ের যোগে আপনি সংশোধিত হইয়া আসে। সাহেব যখন চিঠির শেষে আমাকে লেখেন yours truly, সত্যই তোমারই, তখন তাঁহার এই অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার সত্যপাঠটুকুকে তর্জমা করিয়া আমি এই বুঝি, তিনি সত্যই আমারই নহেন। বিশেষত বড়ো সাহেব যখন নিজেকে আমার বাধ্যতম ভৃত্য বলিয়া বর্ণনা করেন তখন অনায়াসে সে কথাটার ষোলো-আনা বাদ দিয়া তাহার উপরে আরো ষোলোআনা কাটিয়া লইতে পারি। এগুলি বাঁধা দস্তুরের অত্যুক্তি, কিন্তু প্রচলিত ভাষাপ্রয়োগের অত্যুক্তি ইংরেজিতে ঝুড়িঝুড়ি আছে। immensely, immeasurably, extremely, awfully, infinitely, absolutely, ever so much, for the life of me, for the world, unbounded, endless প্রভৃতি শব্দ প্রয়োগগুলি যদি সর্বত্র যথার্থভাবে লওয়া যায় তবে প্রাচ্য