Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://xn--u5bxfcqewdax4kraj7ob.xn--45brj9c)


বানান-প্রসঙ্গ, ৩
বানান-প্রসঙ্গ

এই গুরুতর বিষয় প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার উপযোগী আমার শরীরের অবস্থা নয়। সংক্ষেপে আমার বক্তব্যের আভাসমাত্র দিলেম।১


৫

প্রাকৃত বাংলার বানান সম্বন্ধে আজ পর্যন্ত কোনো চরম অভ্যাসে আসতে পারি নি। তাড়াতাড়িতে অমনোযোগ তার একটি কারণ। তা ছাড়া বই ছাপাবার সময় প্রুফ দেখার সম্যক ভার নিজে নেবার মতো ধৈর্য বা শক্তি বা সময় নেই—কাজেই আমার ছাপা বইগুলিতে বানান সম্বন্ধে সুনির্দিষ্টতার পরিচয় পাওয়া যায় না। এই কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্য দাবি করেছিলুম। তাঁরা দশে মিলে যেটা স্থির করে দেবেন সেটা নিয়ে আর দ্বিধা করব না। ২

৬

আমাদের সাহিত্যে প্রাকৃত বাংলার প্রচলন প্রতিদিন বেড়ে উঠেছে। সেই বাংলায় বানান সম্বন্ধে কোনো আইন নেই, তাই স্বেচ্ছাচারের অরাজকতা চলেছে। যারা হবেন প্রথম আইনকর্তা তাঁদের বিধান অনিন্দনীয় হতেই পারে না, তবু উচ্ছৃঙ্খলতার বাঁধ বেঁধে দেবার কাজ তো শুরু করতেই হবে। সেইজন্যে বিশ্ববিদ্যালয়েরই শরণ নিতে হল। কালক্রমে তাঁদের নিয়মের অনেক পরিবর্তন ঘটবে সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই পরিবর্তনের গতি একটা সুচিন্তিত পথ অনুসরণ যদি না করে তা হলে অব্যবস্থার অন্ত থাকবে না। নদীর তট বাঁধা আছে তবু তার বাঁক পরিবর্তন হয়, কিন্তু তট না থাকলে তার নদীত্বই ঘুচবে, সে হবে জলা।

আমার প্রদেশের নাম আমি লিখি বাংলা। হসন্ত ঙ-র চিহ্ন ং। যেমন হসন্ত ত-য়ের চিহ্ন ৎ। “বাঙ্গলা” মুখে বলি নে লিখতেও চাই নে। যুক্তবর্ণ ঙ্গ-এ হসন্ত চিহ্ন নিরর্থক। ঙ-র সঙ্গে হসন্ত চিহ্ন দেওয়া চলে, কিন্তু দরকার কী, হসন্ত চিহ্ন যুক্ত ঙ-র স্বকীয়রূপ তো বর্ণমালায় আছে—সেই অনুস্বরকে আমি মেনে নিয়ে থাকি।

৭

শব্দতত্ত্ব গ্রন্থে লেখায় চিহ্ন বর্জন সম্বন্ধে আমার মত প্রকাশ করেছি। নিত্য-ব্যবহারে আমার এ মত চলবে না তা জানি। এটা একটা আলোচনার বিষয় মাত্র। চিহ্নগুলোর প্রতি অতিমাত্র নির্ভরপরতা অভ্যস্ত হলে ভাষায় আলস্যজনিত দুর্বলতা প্রবেশ করে এই আমার বিশ্বাস। চিহ্নসংকেতের সহায়তা পাওয়া যাবে না এ কথা যদি জানি তবে ভাষার আপন সংকেতের দ্বারাতেই তাকে প্রকাশবান করতে সতর্ক হতে পারি; অন্তত আজকাল ইংরেজির অনুকরণে, লিখিত ভাষাগত ইঙ্গিতের জন্যে চিহ্নসংকেতের অকারণ বাড়াবাড়ি সংযত হতে পারে। এই চিহ্নের প্রশ্রয় পেয়ে পাঠসম্বন্ধে পাঠকদেরও মন পঙ্গু হয় প্রকাশ-সম্বন্ধে লেখকদেরও তদ্রূপ। কোনো কোনো মানুষ আছে কথাবার্তায় যাদের অঙ্গভঙ্গি অত্যন্ত বেশি। সেটাকে মুদ্রাদোষ বলা যায়। বোঝা যায় লোকটার মধ্যে সহজ ভাবপ্রকাশের ভাষাদৈন্য আছে। কিন্তু কথার সঙ্গে ভঙ্গি একেবারে চলবে না এ কথা বলা অসংগত তেমনি লেখার সঙ্গে চিহ্ন সর্বত্রই বর্জনীয়

১ - চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যকে লিখিত পত্র।

২ - দিলীপকুমার রায়কে লিখিত পত্র