Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://xn--u5bxfcqewdax4kraj7ob.xn--45brj9c)


নিখিলবঙ্গসংগীতসম্মেলন,১
নিখিলবঙ্গসংগীতসম্মেলন

২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৪, ১১ পৌষ ১৩৪১ তারিখে কলিকাতা সিনেট হাউসে অল বেঙ্গল মিউজিক কন্‌ফারেন্সের উদ্‌বোধন-বক্তৃতা

 

আজ এখানে এসে আমি শুধু এই কথাই বলব যে, এখানে আমার বলার কী যোগ্যতা আছে। বস্তুত যাকে ধ্রুবপদ্ধতি-সংগীত বলা হয় সে সম্বন্ধে স্বীকার করতেই হবে যে, আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সংকীর্ণ-সেইজন্য আজকের দিনে এই সভায় অবতরণিকার কর্তব্যের ভার যে আমি নিয়েছি তার দায়িত্ব তাঁদের যাঁরা এই ভার দিয়েছেন।

এখানে প্রবেশ করবার প্রারম্ভে আমার কোনো তরুণ বন্ধু অনুরোধ করেছেন সংগীত সম্বন্ধে আমার যা মত তা দীর্ঘ করে এই সুযোগে যেন ব্যাখ্যা করি। তাঁর অনুরোধ পালন করা নানা কারণে আমার অসাধ্য হবে। আজ সকালেই আমি আর-একটি কর্তব্য পালন করে এসেছি–প্রবাসীবঙ্গসাহিত্যসম্মেলনের উদ্‌বোধন করে; সেখানে তেমন কুণ্ঠা বোধ করি নি, কেননা তাতে আমি অভ্যস্ত। সেখানের যত সুখ, যত দুঃখ, যত খ্যাতি, যত অখ্যাতি, তা আজ পঞ্চাশ বৎসর ধরে বরণ করে এসেছি। সেখানে গিয়ে আমাকে পড়তে হয়েছে, তাতে দুর্বল শ্বাসযন্ত্রের প্রতি অত্যাচার হয়েছে। আর অত্যাচার করলে ধর্মঘটের আশঙ্কা আছে।

দ্বিতীয় কথা, সংগীত এমন একটি বিষয় যা নিয়ে সংসারে প্রায়ই পণ্ডিতে পণ্ডিতে এমন দ্বন্দ্ব বাধে যার সমাপ্তি হয় অপঘাতে। অনেক সময় তম্বুরা গদার কার্য করে–সুরাসুরের এমন যুদ্ধ বাধে যা প্রায় য়ুরোপের মহাযুদ্ধের সমকক্ষ। প্রাচীনকালে সংগীত বিষয়ে যে যা বলেছেন সে সম্বন্ধে জ্ঞানের গভীরতা আমার নাই, কাজেই সে সমস্যা আমি এখানে তুলব না। পরবর্তী বক্তারা সে সম্বন্ধে বলবেন। আমি সাধারণভাবে বললে সকলের কাছে তা গ্রাহ্য হবে কিনা জানি না, কিন্তু প্রাচীন শাস্ত্রের প্রতি অশ্রদ্ধা না করে আমার মন্তব্য সরল ভাষায় বলব।

সংগীত একটি প্রাণধর্মী জিনিস এবং প্রাণের প্রকাশ তার মধ্যে আছে এ কথা বলা বাহুল্য। চতুর্দিকের [পারিপার্শ্বিকের] ক্রিয়াবান প্রত্যুত্তর এবং [সে] যা পেয়েছে তার চেয়ে বেশি কিছু পাবার জন্য অন্তরের দাবি, প্রেরণা–এই দুইটি লক্ষণকে মিলিয়ে সংগীতের তত্ত্বকে প্রয়োগ করতে ইচ্ছা করি। যে স্পর্শ আমাদের প্রতিনিয়ত হচ্ছে তারই প্রত্যুত্তররূপে আমাদের চিত্ত থেকে এটা প্রকাশ পায়। প্রাণের যে ধর্ম, সংগীতেরও হবে সেই ধর্ম। তা যদি হয় তা হলে আমাদের এ কথা চিন্তা করতে হবেই যে ক্রমাগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রাণের যে গতি প্রতিনিয়ত অগ্রসর হচ্ছে তার কল্লোল, তার ধ্বনি, একটা কোনো নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারে না। এক সময় মোগলের আমলে রাজৈশ্বর্য যখন উচ্ছ্বসিত–সেই সময় তানসেন প্রভৃতি সুধীগণ সংগীতের যে রূপ দিয়েছিলেন তা তৎকালীন সাম্রাজ্যের সহিত জড়িত। তখনকার কালে শ্রোতাদের কানে যে গান যথার্থ তাঁদের নিজের অন্তরের জিনিস হবে, সেই গানই তাঁরা উপহার দিয়েছিলেন। তা তৎকালীন পারিপার্শ্বি[কের] ক্রিয়াবান প্রত্যুত্তর। সেই surroundings যে আজকে নেই এ কথা নিঃসন্দেহ। বৈদিক যুগে এক রকম সংগীত ছিল—’সামগান’। সেই সামগান নিঃসন্দেহে তখনকার যাঁরা সাধক ছিলেন তাঁদের হৃদয় থেকে উচ্ছ্বসিত হয়েছিল–বিশেষ রূপ নিয়ে তখনকার ক্রিয়াকর্ম যজ্ঞে তা রসরূপ পেয়েছে ও পূর্ণতা লাভ করেছে। পরবর্তীকালে তা এত দূরে গিয়ে পড়েছে যে তখনকার সেই সামগান কিরকম ছিল তা আমরা নিঃসংশয়ে বলতে পারি না। তার পর এল কালিদাস বিক্রমাদিত্যের যুগ। তখনকার সংগীত নৃত্য গীত বিশেষত্ব লাভ করেছিল সেই সময়কার গভীর সাম্রাজ্যগৌরব এবং আবেষ্টনীর মধ্য দিয়ে। আনন্দ যখন হয়ে উঠেছিল অভ্রভেদী, তখন তারই অনুরূপ সংগীত যে জন্মেছিল তাতে সন্দেহ নেই।