২৯ জুলাই ১৯৩৭
কীর্তনগীত আমি অনেক কাল থেকেই ভালোবাসি। ওর মধ্যে ভাবপ্রকাশের যে নিবিড় ও গভীর নাট্যশক্তি আছে সে আর-কোনো সংগীতে এমন সহজভাবে আছে বলে আমি জানি নে। সাহিত্যের ভূমিতে ওর উৎপত্তি, তার মধ্যেই ওর শিকড়, কিন্তু ও শাখায় প্রশাখায় ফলে ফুলে পল্লবে সংগীতের আকাশে স্বকীয় মহিমা অধিকার করেছে। কীর্তনসংগীতে বাঙালির এই অনন্যতন্ত্র প্রতিভায় আমি গৌরব অনুভব করি।... কখনো কখনো কীর্তনে ভৈরোঁ প্রভৃতি ভোরাই সুরেরও আভাস লাগে, কিন্তু তার মেজাজ গেছে বদলে–রাগরাগিণীর রূপের প্রতি তার মন নেই, ভাবের রসের প্রতিই তার ঝোঁক। আমি কল্পনা করতে পারি নে হিন্দুস্থানী গাইয়ে কীর্তন গাইছে, এখানে বাঙালির কণ্ঠ ও ভাবার্দ্রতার দরকার করে। কিন্তু, তৎসত্ত্বেও কি বলা যায় না যে এতে সুরসমবায়ের পদ্ধতি হিন্দুস্থানী পদ্ধতির সীমা লঙঘন করে না? অর্থাৎ, য়ুরোপীয় সংগীতের সুরপর্যায় যে রকম একান্ত বিদেশী কীর্তন তো তা নয়। ওর রাগরাগিণীগুলিকে বিশেষ নাম দিয়ে হিন্দুস্থানী সংগীতের সংখ্যা বৃদ্ধি করলে উপদ্রব করা হয় না। কিন্তু, ওর প্রাণ, ওর গতি, ওর ভঙ্গি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।
২৯ অক্টোবর ১৯৩৭
‘ছন্দা’য় তোমার ‘কথা বনাম সুর’ প্রবন্ধে তোমার তর্কটা খুব জোরালো হয়েছে। কিন্তু, তর্কে বিজ্ঞান বা গণিত ছাড়া আর কোনো-কিছুর মীমাংসা হতে চায় না। যদি কেউ হুংকার দিয়ে বলেন বিশুদ্ধ সংস্কৃত ভাষায় আম্র বলা যেতে পারে একমাত্র ফজলিকে–যদি তার আয়তন, তার ওজন, তার আঁটির বিশালতা প্রমাণস্বেরূপে সে ব্যবহার করে–যদি বলে গুরুত্বহীন অন্য সমস্ত আমকে সংস্কৃত নামে অভিহিত করা চলবে না, বড়ো জোর গ্রাম্য ভাষায় ‘আঁব’ নামেই তাদের পরিচয় দেওয়া যেতে পারে–তা হলে জামাইষষ্ঠীর দিনে ফজলি আম দিয়ে তার সম্মান রক্ষা করা শ্বশুরের পক্ষে নিরাপদ হবে, কিন্তু ইতরে জনাঃ বিচিত্র আমের বিচিত্র রস সম্ভোগ ক’রে সমজদার নাম খোয়াতে কুণ্ঠিত হবে না। ওস্তাদেরা ফজলি-সংগীতের কলমের চারা বানাতে থাকুন যুগ যুগান্তর ধরে, তৎসত্ত্বেও মানুষের হৃদয়পদ্মে সৃষ্টিকর্তা ঘুমিয়ে পড়বেন না।
সুরের সঙ্গে কথার মিলন কেউ রোধ করতে পারবে না। ওরা পরস্পরকে চায়, সেই চাওয়ার মধ্যে যে প্রবল শক্তি আছে সেই শক্তিতেই সৃষ্টির শক্তিতেই সৃষ্টির প্রবর্তনা। শ্রেণীর বেড়ার মধ্যে পায়ের বেড়ির ঝংকার দিয়ে বেড়ানোকেই যে ওস্তাদ সাধনা বলে গণ্য