প্রণত
ধূর্জটি
শান্তিনিকেতন
কল্যাণীয়েষু
লাঠিয়াল যখন প্রতিপক্ষের আক্রমণ সামলানো কঠিন বলে বোঝে তখন সে মাটিতে বসে পড়ে দেহ সংকোচ করে, অর্থাৎ আঘাতের লক্ষ্যক্ষেত্রকে যথাসাধ্য সংকীর্ণ করতে চায়। তোমার এবারকার প্রশ্নবর্ষণ সম্বন্ধে আমার মনের ভাবটা সেই ধরনের। সংক্ষেপে উত্তর দিলে বিপদকেও সংক্ষিপ্ত করা যায়। দেখি কৃতকার্য হতে পারি কিনা। race অর্থাৎ গণজাতির অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য আছে কিনা এইটি তোমার প্রথম প্রশ্ন। এ সম্বন্ধে চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত দিলে কথাটা পরিষ্কার হয়। আকৃতির সহজাত বৈশিষ্ট্য অস্বীকার করবার জো নেই। চৈনিকের চেহারার সঙ্গে নিগ্রোর চেহারার সঙ্গে নিগ্রোর চেহারার তফাত নিয়ে তর্ক চলে না। আকৃতির ভেদ প্রকৃতির ভেদের কোনো সূচনা করে না এ কথা শ্রদ্ধের নয়। কাঁঠালের সঙ্গে তুলনায় সব আমেই মূল রসবস্তুর ঐক্য মানতে হয়, কিন্তু ন্যাংড়া আম ও ফজলি আমের মধ্যে রসবৈশিষ্ট্যের যে ভেদ আছে, আকৃতিতে তার ইশারা এবং প্রকৃতিতে তার প্রমাণ যথেষ্ট। আল্ফন্সোর কৌলীন্য বাইরের চেহারার থেকে শুরু করে ভিতরের আঁঠি পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। তার বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গে পরিচয়ের যোগ আছে।
যাকে সংস্কৃতি বলে থাকি, অর্থাৎ কাল্চার্ সমস্ত য়ুরোপীয় জাতির মধ্যে তা অনবচ্ছিন্ন। এই সংস্কৃতির বুদ্ধিক্ষেত্রে ওদের পরস্পরের সীমাচিহ্ন প্রায় মিলিয়ে গেছে। ওদের সায়ান্সের মধ্যে জাতিভেদ নেই, সমান হাটে ওদের বুদ্ধিবৃত্তির দেনাপাওনা অবারিত। কিন্তু ওদের হৃদয়বৃত্তির মধ্যে পঙ্ক্তিভেদ আছে। অনুভূতিতে ইটালীর এবং নর্বেজীয় এক নয়, ইংরেজ এবং ফরাসীর মধ্যেও প্রভেদ আছে। সে কেবলমাত্র ওদের রাষ্ট্রচালনায় নয়, ওদের শিল্পভাবনায় প্রকাশ পায়। বলা বাহুল্য জর্মান ও ফরাসীর চরিত্র ভিন্ন। জর্মানি ও ইটালির ভৌগোলিক দূরত্ব অল্পই। কিন্তু ইটালির সীমা পেরিয়ে জর্মানিতে প্রবেশ করবামাত্রই উভয় দেশের লোকের প্রকৃতিগত প্রভেদ সুস্পষ্ট অনুভব করা যায়।
এই প্রভেদটি কুলক্রমে রক্তমাংস অস্থিমজ্জায় সঞ্চারিত হয়ে চলেছে অথবা বাইরের নানা ঐতিহাসিক কারণে এটা সংঘটিত–সে তর্ক আমাদের বর্তমান আলোচনার পক্ষে অনাবশ্যক। ভিন্ন ভিন্ন গণজাতির মধ্যে চরিত্রগত হৃদয়গত প্রভেদ অন্তত দীর্ঘকাল থেকে চলে আসছে এ কথা মানতেই হবে, চিরকাল চলবে কিনা সে আলোচনা অবান্তর।
ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানুষের বুদ্ধির ক্ষেত্র সমভূমি না হলেও, এক মাটির। সেখানে চাষ করতে করতে ক্রমে অনুরূপ ফসল ফলানো যেতে পারে। তার প্রমাণ জাপান। সেখানকার মাটিতে পারমার্থিক ও ব্যাবহারিক সায়ান্স শিকড় চালিয়ে দিয়ে পাশ্চাত্য শস্যের ফলনে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। য়ুরোপের বৌদ্ধিক প্রকৃতিকে সাধনাদ্বারা আমরা অঙ্গীকৃত করতে পারি তার কিছু-কিছু প্রমাণ দেওয়া গেছে। কিন্তু, তার চরিত্রকে পাচ্ছি নে, নানা শোচনীয় ব্যর্থতায় সেটা প্রত্যহ সুস্পষ্ট হল।
চরিত্র কর্মসৃষ্টিতে এবং হৃদয়বৃত্তি ও কল্পনাশক্তি রসসৃষ্টিতে আপন পরিচয় দিয়ে থাকে। তাই য়ুরোপীয় সংগীতের কাঠামো এক