Published on রবীন্দ্র রচনাবলী (https://xn--u5bxfcqewdax4kraj7ob.xn--45brj9c)


ব্যক্তি প্রসঙ্গ,৫৭
ব্যক্তি প্রসঙ্গ
মধ্যে নিত্যতা নেই। এই রকমের ছোটো ছোটো সম্বন্ধসূত্র ছিন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জীবনের এই অকিঞ্চিৎকর ভূমিকা লুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু এই যদি আমাদের একমাত্র পরিচয় হয় তা হলে মৃত্যুর মতো শূন্যতা আর কী হতে পারে। প্রাণপণ চেষ্টায় প্রাণ-ধারণের দুঃখ স্বীকার কীজন্যে যদি মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সত্তার সমগ্র পরিচয় নিঃশেষিত হয়ে যায়। মানুষের মন থেকে এ সংস্কার কিছুতেই ঘোচে না যে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে বেঁচে থাকা, অথচ সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না, একদিন তাকে মরতেই হয়। মানুষ তবে কার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে? জীব-প্রকৃতির। সে উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, জীবপ্রবাহ রক্ষা করা চলা।

মরতে মরতেও আমরা নানা রকম তাগিদে তার সেই উদ্দেশ্য সাধন করি। প্রলোভনে, শাসনে ও মোহে প্রকৃতি ফাঁকি দিয়ে আপন কাজ করিয়ে নেয়। প্রতিদিন নগদ পাওনা দিয়ে খাটিয়ে নিয়ে কাজ শেষ হলেই এক নিমেষেই বিদায় দেয় শূন্যহাতে। বাইরে থেকে দেখলে ব্যক্তিগত জীবনের এই আরম্ভ এই শেষ। প্রকৃতির হাতে এই তার অবমাননা। কিন্তু তাই যদি একান্ত সত্য হয়, তা হলে প্রকৃতির প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাকেই শ্রেয় বলতুম। কিন্তু মন তো তাতে সায় দেয় না।

আছি এই উপলব্ধিটাও আমার কাছে অন্তরতম। এইজন্য নিরতিশয় নাস্তিত্বের কোনো লক্ষণকে চোখে দেখলেও মনে তাকে মানতে এত বেশি বাধে। মৃত্যুকে আমরা বাইরে দেখি অথচ নিজের অন্তরে তার সম্পূর্ণ ধারণা কিছুতেই হয় না। তার প্রধান কারণ নিজেকে দেখি সকলের সঙ্গে জড়িয়ে—আমার অস্তিত্ব সকলের অস্তিত্বের যোগে। উপনিষদ বলেছেন, নিজেকে যে অন্যের মধ্যে জানে সে-ই সত্যকে জানে। তার মৃত্যু নেই, মৃত্যু আছে স্বতন্ত্র আমির। অহমিকায় নিজেকে নিজের মধ্যেই রুদ্ধ করি, নিজেকে অন্যের মধ্যে বিস্তার করি প্রেমে। অহমিকায় নিজেকে আঁকড়ে থাকতে চাই, প্রেমে প্রাণকেও তুচ্ছ করতে পারি—কেননা, প্রেমে অমৃত।

মানুষ সাধনা করে ভূমার, বৃহতের। সে বলেছে যা বড়ো তাতেই সুখ, দুঃখ ছোটোকে নিয়ে। যা ছোটো তা সমগ্রের থেকে অত্যন্ত বিচ্ছিন্ন বলেই অসত্য। তাই ছোটোখাটোর সঙ্গে জড়িত আমাদের যত দুঃখ। আমার ধন, আমার জন, আমার খ্যাতি,আমি-গণ্ডি দিয়ে স্বতন্ত্র-করা যা-কিছু, তাই মৃত্যুর অধিকারে; তাকে নিয়েই যত বিরোধ, যত উদ্‌বেগ, যত কান্না। মানুষের সভ্যতার ইতিহাস তার অমর সম্পদ-সাধনার ইতিহাস। মানুষ মৃত্যুকে স্বীকার করে এই ইতিহাসকে রচনা করছে, সকল দিক থেকে সে আপন উপলব্ধির সীমাকে যুগে যুগে বিস্তার করে চলেছে বৃহতের মধ্যে। যা-কিছুতে সে চিরন্তনের স্বাদ পায় তাকে সেই পরিমাণেই সে বলে শ্রেষ্ঠ।

দুই শ্রেণীর বৃহৎ আছে। যশ্চায়মস্মিন্‌ আকাশে, আর যশ্চায়মস্মিন্‌ আত্মনি। এক হচ্ছে আকাশে ব্যাপ্ত বস্তুর বৃহত্ত্ব, আর হচ্ছে আত্মায় আত্মায় যুক্ত আত্মার মহত্ত্ব। বিষয়-রাজ্যে মানুষ স্বাধীনতা পায় জলে স্থলে আকাশে—যাকে সে বলে প্রগতি। এই বস্তুজ্ঞানের সীমাকে সে অগ্রসর করতে করতে চলে। এই চলায় সে কর্তৃত্ব লাভ করে, সিদ্ধি লাভ করে। মুক্তিলাভ করে আত্মার ভূমায়, সেইখানে তার অমরতা। বস্তুকে তার বৃহৎস্বরূপে গ্রহণ করার দ্বারা আমরা ঐশ্বর্য পাই, আত্মাকে তার বৃহৎ ঔদার্যে দান করার দ্বারাই আমরা সত্যকে লাভ করি।

বৌদ্ধধর্মে দেখি বলা হয়েছে, মুক্তির একাট প্রধান সোপান মৈত্রী। কর্তব্যের পথে আমরা আপনাকে দিতে পারি পরের জন্যে। সেটা নিছক দেওয়া, তার মধ্যে নিজের মধ্যে পরকে ও পরের মধ্যে নিজেকে উপলব্ধি নেই। মৈত্রীর পথে যে দেওয়া তা নিছক কর্তব্যের দান নয়; তার মধ্যে আছে সত্য উপলব্ধি।

সংসারে সকলের বড়ো সাধনা অন্যের জন্য আপনাকে দান করা, কর্তব্যবুদ্ধিতে নয়—মৈত্রীর আনন্দে অর্থাৎ ভালোবেসে। মৈত্রীতেই অহংকার যথার্থ লুপ্ত হয়, নিজেকে ভুলতে পারি। যে পরিমাণে সেই ভুলি সেই পরিমাণেই বেঁচে থেকে আমরা অমৃতের অধিকারী হই। আমাদের সেই আমি যায় মৃত্যুতে সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যা অহমিকা দ্বারা খণ্ডিত।

আজকে যা বলতে এসেছি এই তার ভূমিকা।