জীবন ও বর্ণমালা
আমাদের পণ্ডিত মহাশয়ের এমনি খরদৃষ্টি (বলা বাহুল্য, ‘খরদৃষ্টি’ ষষ্ঠী তৎপুরুষ নহে) যে তাঁহার দৃষ্টির সম্মুখে একটি তৃণ পর্যন্তও এড়ায় না। তিনি সকলেরই মধ্যে গূঢ় অর্থ দেখিতে পান। যে যেমন ভাবেই কথা কহুক-না-কেন, তিনি তাহার মধ্য হইতে এমন একটি ভাব বাহির করিতে পারেন, যাহা বক্তার ও শ্রোতার মনে কস্মিন কালেও উদয় হয় নাই। ইহাকেই বলে প্রতিভা! প্রতি সামান্য কথার অসামান্য অর্থসকল বাহির করিয়া সংসারে তিনি এত অনর্থের উৎপত্তি করিয়াছেন যে, এ বিষয়ে কেহ তাঁহার সমকক্ষ হইতে পারে না! সাধারণ যশের কথা! এই অতি উদার মহৎ গুণ প্রতিপদে চালনা করিতে করিতে দৈবাৎ মাঝে মাঝে এক-একটা অতি নিরীহ কার্যও তিনি সাধন করিয়া থাকেন। সম্প্রতি তিনি বর্ণমালার গূঢ় অর্থ বাহির করিয়াছেন অথচ তাহাতে কাহারো সর্বনাশ করা হয় নাই এই নিমিত্ত তাহা সংক্ষেপে পাঠকদের উপহার দিব।

এই পণ্ডিত-প্রবর আজ পঁচিশ বৎসর, বর্ণজ্ঞানশূন্য শিশুদের কর্ণধার হইয়া তাহাদিগকে জ্ঞান-তরঙ্গিণী পার করিয়া আসিতেছেন। যদি কোনো শিশু বিস্মৃতির ভাটায় এক পা পিছাইয়া পড়ে, তবে তাহার কর্ণ ধরিয়া এমন সুন্দর ঝিঁকা মারিতে পারেন যে, সে আর এগোইবার পথ পায় না। ‘উঃ’ ‘ইঃ’ ‘আঃ’ প্রভৃতি স্বরবর্ণগুলি অতি সহজে, সতেজে ও সমস্ত মনের সহিত উচ্চারণ করাইবার জন্য তিনি অতি সহজ কতকগুলি কৌশল উদ্ভাবন করিয়াছেন। অতএব বর্ণমালা সম্বন্ধে ইহার কথাগুলি বিনা উত্তরে শিরোধার্য করা উচিত।

লিখিত ভাষা-বিশেষ পড়িবার জন্য যে বর্ণমালা বিশেষ উপযোগী তাহা নহে। তাহাতে জাতীয় জীবন প্রতিবিম্বিত থাকে। একটা উদাহরণ দিলেই সমস্ত স্পষ্ট হইবে। ইংরেজদের ও আমাদের বিবাহ পদ্ধতির কী প্রভেদ, তাহা দেখিতে মনুও খুলিতে হইবে না, ইতিহাসও পড়িতে হইবে না; বর্ণমালা অনুসন্ধান করিয়া দেখো, বাহির হইয়া পড়িবে। ইংরেজী বর্ণমালায় ‘L’ অক্ষরের পর ‘M’ অর্থাৎ Love-এর পর Marriage। আমাদের বর্ণমালায় ‘ব’-এর পর ‘ভ’ অর্থাৎ বিবাহের পর ভালোবাসা। ইহার উপরে আর কথা আছে? আসল কথা এই, সমাজ যে নিয়মে গঠিত হয়, বর্ণমালাও সেই নিয়মে গঠিত হয়।

যাহা হউক, কয়েক বৎসর ধরিয়া পণ্ডিত মহাশয় তাঁহার বিশাল নাসাগহ্বরে এক-এক টিপ করিয়া নস্য নামাইয়াছেন ও বর্ণজ্ঞান-সমুদ্র হইতে এক-এক রাশি রত্ন তুলিয়াছেন। পাঠকদিগকে তাহার নমুনা দেওয়া যাইতেছে।

আমাদের বর্ণমালায় পাঁচটি বর্গ আছে, আমাদের জীবনেও পাঁচ ভাগ আছে। কবর্গ, চবর্গ, টবর্গ, তবর্গ, পবর্গ; শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়, বার্ধক্য।

কবর্গ, অর্থাৎ শৈশব। (কঁ)া দা, (খে)লা, (গে)লা, (ঘা) লাগা ও উ আঁ (ঙ) করা; ইহার অধিক আর কিছুই নহে।

চবর্গ, কৈশোর। এখন আর গিলিতে হয় না, (চি)বাইতে শিখিয়াছে; গড়াইতে হয় না, (চ)লিতে শিখিয়াছে; (ছু)টাছুটি করিতে পারে। সামাজিকতার বিকাশ আরম্ভ হইয়াছে। পাঁচ জন সমবয়স্কে মিলিয়া (জ)ড়ো হইতে শিখিয়াছে। কিন্তু প্রথম সামাজিকতার আরম্ভে (ঝ)গড়া হইবেই। অসভ্যদের মধ্যে দেখো। তাহারা একত্র হইয়া ঝগড়া করে, ঝগড়া করিতেই একত্র হয়। দ্বন্দ্ব শব্দের অর্থ মিলন ও বিবাদ উভয়ই। সামাজিকতা শব্দের অর্থও কতকটা সেইরূপ। বালকেরা ঝগড়া আরম্ভ করিয়াছে। এবং পরস্পরের মধ্যে ঈঁ অঁ(ঞ) নামক একটা কুঁজ- বিশিষ্ট বক্র-ভাবের ও তদনুযায়ী মুখভঙ্গির আদান-প্রদান চলিতেছে।

টবর্গ বা যৌবন। এইবার যথার্থ জীবনের আরম্ভ। ইহা পাঁচ বর্গের মধ্যবর্গ। ইহার পূর্বে দুইটি বর্গ জীবনের ভূমিকা; ইহার পরে দুইটি বর্গ জীবনের উপসংহার। এবং এই বর্গই জীবন। এইবার (ট)লমল করে তরী; এ পথে যাইব কী ও পথে যাইব? পথে বিষম