আবশ্যকের মধ্যে অধীনতার ভাব
আবশ্যকের প্রতি আমাদের এক প্রকার ঘৃণা আছে। যাহার মধ্যে আবশ্যকের ভাব যত পরিস্ফুট তাহাকে ততই নীচশ্রেণীয় মনে করি। চাষ নিতান্তই আবশ্যকীয়— বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যে একান্ত আবশ্যকতা তত জাজ্বল্যরূপে নজরে পড়ে না। যাহারা খাটিয়া খায় তাহারা সমাজের পক্ষে একান্ত আবশ্যক এবং তাহারা নীচশ্রেণীয়, যাহারা বসিয়া খায় সমাজের পক্ষে তাহাদের তেমন স্পষ্ট আবশ্যক দেখা যায় না তাহারা উচ্চশ্রেণীয়। ঘটিবাটির প্রতি আমাদের এক ভাব ফুলদানির প্রতি অন্যভাব। এইজন্য আমরা আবশ্যকের বিবাহকে হেয় এবং প্রেমের বিবাহকে উচ্চশ্রেণীয় মনে করি। স্ত্রীকে যদি আবশ্যক জ্ঞান করি তবে স্ত্রী দাসী, স্ত্রীকে যদি ভালোবাসি তবে সে লক্ষ্মী। Marriage de convenance-কে এইজন্য ইংরাজেরা সাধারণত কেমন ঘৃণার ভাবে উল্লেখ করে। প্রকৃত প্রেমের মধ্যে সেই অত্যাবশ্যকতা নাই, এইজন্য তাহার মধ্যে স্বাধীনতার গৌরব আছে, তাহাতে দাসত্ববন্ধন নাই। মর্ত্যের সমস্ত নিয়ম আবশ্যকের নিয়ম, প্রেম যেন সেই নিয়মকে অতিক্রম করিয়া অমর্ত্য উজ্জ্বলভাব ধারণ করে এবং সেই প্রেমের বন্ধনে স্ত্রী-পুরুষের সম্বন্ধের মধ্যে বিশুদ্ধ সম্মানের ভাব আসিয়া পড়ে। মনুষ্য সহস্র আবশ্যক বন্ধনে বদ্ধ প্রকৃতির দাস— কেবল প্রেমের মধ্যে সে আপনাকে স্বাধীন ও গৌরবান্বিত জ্ঞান করে। এই স্বাধীনতার বন্ধন অন্য সকল বন্ধন অপেক্ষা গুরুতর, কারণ অন্য সকল বন্ধন ছিন্ন করিবার প্রয়াস আমাদের মনে সর্বদা জাগ্রত থাকে, এ বন্ধনে সেই প্রয়াসকেও অভিভূত করিয়া রাখে। সেইজন্য এক হিসাবে প্রকৃত স্বাধীনতা সকল অধীনতা অপেক্ষা দৃঢ়তর অধীনতা— কারণ স্বাধীনতা সবল অধীনতা, পরাধীনতা দুর্বল অধীনতা। যথেচ্ছাচারিতাকে আমি স্বাধীনতা বলিতেছি না তাহা, অধীনতার সোপান ও অঙ্গ।