নামঞ্জুর গল্প

সব চেয়ে একটা যুক্তি তাঁর মনে প্রবল হল। তাঁর আশঙ্কা ছিল, স্বভাবতই আমার প্রবৃত্তির ঝোঁকটা আণ্ডামান-মুখো, অতএব কেউ আমাকে সামলাবার না থাকলে অবশেষে একদিন পুলিসের বাহুবন্ধনে বদ্ধ হবই। তাঁর মতলব ছিল, যে কোমল বাহুবন্ধন তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ও স্থায়ী আমার জন্য তারই ব্যবস্থা করে দিয়ে তবে তিনি তীর্থভ্রমণে বার হবেন। আমার বন্ধন নইলে তাঁর মুক্তি নেই।

আমার চরিত্র সম্বন্ধে এইখানে ভুল হিসেব করেছিলেন। কুষ্ঠিতে আমার বধ-বন্ধনের গ্রহটি অন্তিমে আমাকে শকুনি-গৃধিনীর হাতে সঁপে দিতে নারাজ ছিলেন না, কিন্তু প্রজাপতির হাতে নৈব নৈব চ। কন্যাকর্তারা ত্রুটি করেন নি, তাঁদের সংখ্যাও অজস্র। আমার পৈতৃক সম্পত্তির বিপুল সচ্ছলতার কথা সকলেই জানত; অতএব, ইচ্ছা করলে সম্ভবপর শ্বশুরকে দেউলে করে দিয়ে কন্যার সঙ্গে সঙ্গে বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা নহবতে সাহানা বাজিয়ে হাসতে হাসতে আদায় করতে পারতেম। করি নি। আমার ভাবী চরিতলেখক এ কথা স্মরণ রাখেন যে, স্বদেশসেবার সংকল্পের কাছে এককালীন আমার এই বিশ-পঁচিশ হাজার টাকার ত্যাগ। জমা-খরচের অঙ্কটা অদৃশ্য কালিতে লেখা আছে বলে যেন আমার প্রশংসার হিসাব থেকে বাদ না পড়ে। পিতামহ ভীষ্মের সঙ্গে আমার মহৎ চরিত্রের এইখানে মিল আছে।

পিসিমা শেষ পর্যন্ত আশা ছাড়েন নি। এমন সময়ে ভারতের পোলিটিক্যাল আকাশে আমাদের সেই ক্ষাত্রযুগের পরবর্তী যুগের হাওয়া বইল। পূর্বেই বলেছি, এখনকার পালায় আমরা প্রধান নায়ক নই, তবু ফুট্‌ লাইটের অনেক পিছনে মাঝে মাঝে নিস্তেজভাবে আমাদের যাওয়া-আসা চলছে। এত নিস্তেজ যে, পিসিমা আমার সম্বন্ধে নিশ্চিন্তই ছিলেন। আমার জন্যে কালীঘাটে স্বস্ত্যয়ন করবার ইচ্ছে এককালে তাঁর ছিল, কিন্তু ইদানিং আমার ভাগ্য-আকাশে লাল-পাগড়ির রক্তমেঘ একেবারে অদৃশ্য থাকাতে তাঁর আর খেয়াল রইল না। এইটেই ভুল করলেন।

সেদিন পুজোর বাজারে ছিল খদ্দরের পিকেটিং। নিতান্ত কেবল দর্শকের মতন গিয়েছিলেম— আমার উৎসাহের তাপমাত্রা ৯৮ অঙ্কেরও নিচে ছিল, নাড়ীতে বেশি বেগ ছিল না। সেদিন যে আমার কোনো আশঙ্কার কারণ থাকতে পারে সে-খবর আমার কুষ্ঠির নক্ষত্র ছাড়া আর-সবার কাছে ছিল অগোচর। এমন সময় খদ্দরপ্রচারকারিণী কোনো বাঙালি মহিলাকে পুলিস-সার্জেন্ট দিলে ধাক্কা। মুহূর্তের মধ্যেই আমার অহিংস অসহযোগের ভাবখানা প্রবল দুঃসহযোগে পরিণত হল। সুতরাং অনতিবিলম্বে থানায় হল আমার গতি। তার পরে যথানিয়মে হাজতের লালায়িত কবলের থেকে জেলখানার অন্ধকার জঠরদেশে অবতরণ করা গেল। পিসিমাকে ব’লে গেলেম, “এইবার কিছুকালের জন্যে তোমার মুক্তি। আপাতত আমার উপযুক্ত অভিভাবকের অভাব রইল না, অতএব এই সুযোগে তুমি তীর্থভ্রমণ করে নাওগে। অমিয়া থাকে কলেজের হস্টেলে; বাড়িতেও দেখবার-শোনবার লোক আছে; অতএব, এখন তুমি দেবসেবায় ষোলো আনা মন দিলে দেবমানব কারও কোনো আপত্তির কথা থাকবে না।”

জেলখানাকে জেলখানা বলেই গণ্য করে নিয়েছিলেম। সেখানে কোনোরকম দাবিদাওয়া আবদার উৎপাত করি নি। সেখানে সুখ, সম্মান, সৌজন্য, সুহৃৎ ও সুখাদ্যের অভাবে অত্যন্ত বেশি বিস্মিত হই নি। কঠোর নিয়মগুলোকে কঠোরভাবেই মেনে নিয়েছিলেম। কোনোরকম আপত্তি করাটাই লজ্জার বিষয় ব’লে মনে করতেম।

মেয়াদ পুরো হবার কিছু পূর্বেই ছুটি পাওয়া গেল। চারি দিকে খুব হাততালি। মনে হল যেন বাংলাদেশের হাওয়ায় বাজতে লাগল, ‘এন্‌‍কোর এক্‌‍সেলেন্ট্ ‌!’ মনটা খারাপ হল। ভাবলেম, যে ভুগল সেই কেবল ভুগল। আর, মিষ্টান্নমিতরে জনাঃ, রস পেলে দশে মিলে। সেও বেশিক্ষণ নয়; নাট্যমঞ্চের পর্দা পড়ে যায়, আলো নেভে, তার পরে ভোলবার পালা। কেবল বেড়ি-হাতকড়ার দাগ যার হাড়ে গিয়ে লেগেছে তারই চিরদিন মনে থাকে।

পিসিমা এখনো তীর্থে। কোথায়, তার ঠিকানাও জানি নে। ইতিমধ্যে পুজোর সময় কাছে এল। একদিন সকালবেলায় আমার