নামঞ্জুর গল্প
সম্পাদক-বন্ধু এসে উপস্থিত। বললেন, “ওহে, পুজোর সংখ্যার জন্যে একটা লেখা চাই।”

“জিজ্ঞাসা করলেম, কবিতা। ”

“আরে, না। তোমার জীবনবৃত্তান্ত।”

“সে তো তোমার এক সংখ্যায় ধরবে না।”

“এক সংখ্যায় কেন। ক্রমে ক্রমে বেরোবে।”

“সতীর মৃতদেহ সুদর্শনচক্রে টুকরো টুকরো করে ছড়ানো হয়েছিল। আমার জীবনচরিত সম্পাদকি চক্রে তেমনি টুকরো টুকরো করে সংখ্যায় সংখ্যায় ছড়িয়ে দেবে, এটা আমার পছন্দসই নয়। জীবনী যদি লিখি গোটা আকারে বের করে দেব।”

“না-হয় তোমার জীবনের কোনো-একটা বিশেষ ঘটনা লিখে দাও-না।”

“কী-রকম ঘটনা।”

“তোমার সব চেয়ে কঠোর অভিজ্ঞতা, খুব যাতে ঝাঁজ।”

“কী হবে লিখে।”

“লোকে জানতে চায় হে।”

“এত কৌতূহল? আচ্ছা, বেশ, লিখব।”

“মনে থাকে যেন, সব চেয়ে যেটাতে তোমার কঠোর অভিজ্ঞতা।”

“অর্থাৎ, সব চেয়ে যেটাতে দুঃখ পেয়েছি লোকের তাতেই সব চেয়ে মজা। আচ্ছা, বেশ। কিন্তু নামটামগুলো অনেকখানি বানাতে হবে।”

“তা তো হবেই। যেগুলো একেবারে মারাত্মক কথা তার ইতিহাসের চিহ্ন বদল না করলে বিপদ আছে। আমি সেইরকম মরীয়াগোছের জিনিসই চাই। পেজ প্রতি তোমাকে—”

“আগে লেখাটা দেখো, তার পরে দরদস্তুর হবে।”

কিন্তু, “আর-কাউকে দিতে পারবে না বলে রাখছি। যিনি যত দর হাঁকুন, আমি তার উপরে—”

“আচ্ছা, আচ্ছা, সে হবে।”

শেষকালটা উঠে যাবার সময় বলে গেলেন, “তোমাদের ইনি— বুঝতে পারছ? নাম করব না— ঐ যে তোমাদের সাহিত্যধুরন্ধর— মস্ত লেখক ব’লে বড়াই; কিন্তু, যা বল তোমার স্টাইলের কাছে তার স্টাইল যেন ডসনের বুট আর তালতলার চটি।”

বুঝলেম, আমাকে উপরে চড়িয়ে দেওয়াটা উপলক্ষ্য মাত্র, তুলনায় ধুরন্ধরকে নাবিয়ে দেওয়াটাই লক্ষ্য।

এই গেল আমার ভূমিকা। এইবার আমার কঠোর অভিজ্ঞতার কাহিনী।

‘সন্ধ্যা’ কাগজ যেদিন থেকে পড়তে শুরু, সেইদিন থেকেই আহারবিহার সম্বন্ধে আমার কড়া ভোগ। সেটাকে জেলযাত্রার রিহার্সাল বলা হত। দেহের প্রতি অনাদরের অভ্যাস পাকা হয়ে উঠল। তাই প্রথমবার যখন ঠেললে হাজতে, প্রাণপুরুষ বিচলিত হয় নি। তার পর বেরিয়ে এসে নিজের ’পরে কারও সেবাশুশ্রূষার হস্তক্ষেপমাত্র বরদাস্ত করি নি। পিসিমা দুঃখবোধ করতেন। তাঁকে বলতেম, “পিসিমা, স্নেহের মধ্যে মুক্তি, সেবার মধ্যে বন্ধন। তা ছাড়া, একের শরীরে অন্য শরীরধারীর আইন খাটানোকে বলে ডায়ার্কি, দ্বৈরাজ্য – সেইটের বিরুদ্ধে আমাদের অসহযোগ।”

তিনি নিশ্বাস ছেড়ে বলতেন, “আচ্ছা, বাবা, তোমাকে বিরক্ত করব না।”