প্রাণমন

ঐ বটগাছটার সঙ্গে যখন আমার আলাপ শুরু হল তখন বসন্তে ওর পাতাগুলো কচি ছিল; তার নানা ফাঁক দিয়ে আকাশের পলাতক আলো ঘাসের উপর এসে পৃথিবীর ছায়ার সঙ্গে গোপনে গলাগলি করত।

তার পরে আষাঢ়ের বর্ষা নামল; ওরও পাতার রঙ মেঘের মতো গম্ভীর হয়ে এসেছে। আজ সেই পাতার রাশ প্রবীণের পাকা বুদ্ধির মতো নিবিড়, তার কোনো ফাঁক দিয়ে বাইরের আলো প্রবেশ করবার পথ পায় না। তখন গাছটি ছিল গরিবের মেয়েটির মতো; আজ সে ধনীঘরের গৃহিণী, যেন পর্যাপ্ত পরিতৃপ্তির চেহারা।

আজ সকালে সে তার মরকতমণির বিশনলী হার ঝল্‌মলিয়ে আমাকে বললে, “মাথার উপর অমনতরো ইঁটপাথর মুড়ি দিয়ে বসে আছ কেন। আমার মতো একেবারে ভরপুর বাইরে এসো-না।”

আমি বললেম, “মানুষকে যে ভিতর বাহির দুই বাঁচিয়ে চলতে হয়।”

গাছ নড়েচড়ে বলে উঠল, “বুঝতে পারলেম না।”

আমি বললেম, “আমাদের দুটো জগৎ, ভিতরের আর বাইরের।”

গাছ বললে, “সর্বনাশ! ভিতরেরটা আছে কোথায়।”

“আমার আপনারই ঘেরের মধ্যে।”

“সেখানে কর কী।”

“সৃষ্টি করি।”

“সৃষ্টি আবার ঘেরের মধ্যে! তোমার কথা বোঝবার জো নেই।”

আমি বললেম, “যেমন তীরের মধ্যে বাঁধা প’ড়ে হয় নদী, তেমনি ঘেরের মধ্যে ধরা পড়েই তো সৃষ্টি। একই জিনিস ঘেরের মধ্যে আটকা প’ড়ে কোথাও হীরের টুকরো, কোথাও বটের গাছ।”

গাছ বললে, “তোমার ঘেরটা কী রকম শুনি।”

আমি বললেম, “সেইটি আমার মন। তার মধ্যে যা ধরা পড়ছে তাই নানা সৃষ্টি হয়ে উঠছে।”

গাছ বললে, “তোমার সেই বেড়াঘেরা সৃষ্টিটা আমাদের চন্দ্রসূর্যের পাশে কতটুকুই বা দেখায়।”

আমি বললেম, “চন্দ্রসূর্যকে দিয়ে তাকে তো মাপা যায় না, চন্দ্রসূর্য যে বাইরের জিনিস।”

“তা হলে মাপবে কী দিয়ে।”

“সুখ দিয়ে, বিশেষত দুঃখ দিয়ে।”

গাছ বললে, “এই পুবে হাওয়া আমার কানে কানে কথা কয়, আমার প্রাণে প্রাণে তার সাড়া জাগে। কিন্তু, তুমি যে কিসের কথা বললে আমি কিছুই বুঝলেম না।”

আমি বললেম, “বোঝাই কী করে। তোমার ঐ পুবে হাওয়াকে আমাদের বেড়ার মধ্যে ধরে বীণার তারে যেমনি বেঁধে ফেলেছি, অমনি সেই হাওয়া এক সৃষ্টি থেকে একেবারে আর-এক সৃষ্টিতে এসে পৌঁছয়। এই

সৃষ্টি কোন আকাশে যে স্থান পায়, কোন্‌ বিরাট চিত্তের স্মরণাকাশে, তা আমিও ঠিক জানি নে। মনে হয়, যেন বেদনার একটা আকাশ আছে। সে আকাশ মাপের আকাশ নয়।”

“আর, ওর কাল? ”