প্রাণমন

“ওর কালও ঘটনার কাল নয়, বেদনার কাল। তাই সে কাল সংখ্যার অতীত।”

“দুই আকাশ দুই কালের জীব তুমি, তুমি অদ্ভুত। তোমার ভিতরের কথা কিচ্ছুই বুঝলেম না।”

“নাই বা বুঝলে।”

“আমার বাইরের কথা তুমিই কি ঠিক বোঝ।”

“তোমার বাইরের কথা আমার ভিতরে এসে যে কথা হয়ে ওঠে তাকে যদি বোঝা বল তো সে বোঝা, যদি গান বল তো গান, কল্পনা বল তো কল্পনা।”


গাছ তার সমস্ত ডালগুলো তুলে আমাকে বললে, “একটু থামো। তুমি বড়ো বেশি ভাবো, আর বড়ো বেশি বকো।”

শুনে আমার মনে হল, এ কথা সত্যি। আমি বললেম, “চুপ করবার জন্যেই তোমার কাছে আসি, কিন্তু অভ্যাসদোষ চুপ করে করেও বকি; কেউ কেউ যেমন ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও চলে।”

কাগজটা পেন্সিলটা টেনে ফেলে দিলেম, রইলেম ওর দিকে অনিমেষ তাকিয়ে। ওর চিকন পাতাগুলো ওস্তাদের আঙুলের মতো আলোকবীণায় দ্রুত তালে ঘা দিতে লাগল।

হঠাৎ আমার মন বলে উঠল, “এই তুমি যা দেখছ আর এই আমি যা ভাবছি, এর মাঝখানের যোগটা কোথায়।”

আমি তাকে ধমক দিয়ে বললেম, “আবার তোমার প্রশ্ন? চুপ করো।”

চুপ করে রইলেম, একদৃষ্টে চেয়ে দেখলেম। বেলা কেটে গেল।

গাছ বললে, “কেমন, সব বুঝেছ? ”

আমি বললেম, “বুঝেছি।”


সেদিন তো চুপ করেই কাটল।

পরদিনে আমার মন আমাকে জিজ্ঞাসা করলে, “কাল গাছটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠলে ‘বুঝেছি’, কী বুঝেছ বলো তো।”

আমি বললেম, “নিজের মধ্যে মানুষের প্রাণটা নানা ভাবনায় ঘোলা হয়ে গেছে। তাই, প্রাণের বিশুদ্ধ রূপটি দেখতে হলে চাইতে হয় ঐ ঘাসের দিকে, ঐ গাছের দিকে।”

“কী রকম দেখলে।”

“দেখলেম, এই প্রাণের আপনাতে আপনার কী আনন্দ। নিজেকে নিয়ে পাতায় পাতায়, ফুলে ফুলে, ফলে ফলে, কত যত্নে সে কত ছাঁটই ছেঁটেছে, কত রঙই লাগিয়েছে, কত গন্ধ, কত রস। তাই ঐ বটের

দিকে তাকিয়ে নীরবে বলছিলেম— ওগো বনস্পতি, জন্মমাত্রই পৃথিবীতে প্রথম প্রাণ যে আনন্দধ্বনি করে উঠেছিল সেই ধ্বনি তোমার শাখায় শাখায়। সেই আদিযুগের সরল হাসিটি তোমার পাতায় পাতায় ঝল্‌মল্‌ করছে। আমার মধ্যে সেই প্রথম প্রাণ আজ চঞ্চল হল। ভাবনার বেড়ার মধ্যে সে বন্দী হয়ে বসে ছিল; তুমি তাকে ডাক দিয়ে বলেছ, ওরে আয়-না রে আলোর মধ্যে, হাওয়ার