প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
গ্রহণ করিতে পারি না। ইহাঁরা কঠিন নৈয়ায়িক লোক, ন্যায়শাস্ত্র অনুসারে সকল কথা বাজাইয়া লন, কবিতার তুলনা উপমা প্রভৃতি ন্যায়শাস্ত্রের নিকট যাচাই করিয়া তবে গ্রহণ করেন। অতএব ইহাঁদের কাছে শাস্ত্র অনুসারেই কথা কহা যাক। জগৎসংসারে কোন্ জিনিষটা একেবারে স্বতন্ত্র, কোন্ জিনিষটা এত বড় প্রতাপান্বিত যে কোন কিছুর সহিত কোন সম্পর্ক রাখে না? জড়বুদ্ধিরা সকল জিনিষকেই পৃথক করিয়া দেখে, তাহাদের কাছে সবই স্ব-স্ব-প্রধান। বুদ্ধির যতই উন্নতি হয় ততই সে ঐক্য দেখিতে পায়। বিজ্ঞান বল, দর্শন বল, ক্রমাগত একের প্রতি ধাবমান হইতেছে। সহজচক্ষে যাহাদের মধ্যে আকাশ পাতাল, তাহারাও অভেদাত্মা হইয়া দাঁড়াইতেছে। এ বিশ্বরাজ্যে বিজ্ঞান বৈজ্ঞানিক ঐক্য, দর্শন দার্শনিক ঐক্য দেখাইতেছে, কবিতা কি অপরাধ করিল? তাহার কাজ জগতের সৌন্দর্য্যগত ভাবগত ঐক্য বাহির করা। তুলনার সাহায্যে কবিতা তাহাই করে; তাহাকে যদি তুমি সত্য বলিয়া শিরোধার্য্য না কর, কল্পনার ছেলেখেলা মাত্র মনে কর, তাহা হইলে কবিতাকে অন্যায় অপমান করা হয়। কবিতা যখন বলে, তারাগুলি আকাশে চলিতে চলিতে গান গাহিতেছে, যথা –
তখন তুমি অনুগ্রহপূর্বক শুনিয়া গিয়া কবিকে নিতান্তই বাধিত কর। মনে মনে বলিতে থাক, তারা চলিতেছে ইহা স্বীকার করি, কিন্তু কোথায় চলা আর কোথায় গান গাওয়া! চলাটা চোখে দেখিবার বিষয় আর গান গাওয়াটা কানে শুনিবার—তবে অলঙ্কারের হিসাবে মন্দ হয় নাই। কিন্তু হে তর্কবাচস্পতি, বিজ্ঞান যখন বলে বাতাসের তরঙ্গলীলাই ধ্বনি, তখন তুমি কেন বিনা বাক্যব্যয়ে অম্লানবদনে কথাটাকে গলাধঃকরণ করিয়া ফেল! কোথায় বাতাসের বিশেষ একরূপ কম্পন-নামক গতি, আর কোথায় আমাদের শব্দ শুনিতে পাওয়া! সচরাচর বাতাসের গতি আমাদের স্পর্শের বিষয়, কিন্তু শব্দে ও স্পর্শে যে ভাই-ভাই সম্পর্ক ইহা কে জানিত! বৈজ্ঞানিকেরা পরীক্ষা করিয়া জানিয়াছেন, কবিরা হৃদয়ের ভিতর হইতে জানিতেন। কবিরা জানিতেন, হৃদয়ের মধ্যে এমন একটা জায়গা আছে যেখানে শব্দ স্পর্শ ঘ্রাণ সমস্ত একাকার হইয়া যায়। তাহারা যতক্ষণ বাহিরে থাকে ততক্ষণ স্বতন্ত্র। তাহারা নানা দিক্ হইতে নানা দ্রব্য স্বতন্ত্র ভাবে উপার্জন করিয়া আনে, কিন্তু হৃদয়ের অন্তঃপুরের মধ্যে সমস্তই একত্রে জমা করিয়া রাখে, এবং এমনি গলাগলি করিয়া থাকে যে কোন্টি যে কে চেনা যায় না। সেখানে গন্ধকে স্পৃশ্য বলিতে আপত্তি নাই, রূপকে গান বলিতে বাধে না। পূর্বেই ত বলা হইয়াছে, যেখানে গভীর সেখানে সমস্তই একাকার। সেখানে হাসিও যা কান্নাও তা, সেখানে সুখমিতি বা দুঃখমিতি বা। জ্ঞানে যাহারা বর্ব্বর তাহারা যেমন জগতে বৈজ্ঞানিক ঐক্য দার্শনিক ঐক্য দেখিতেও পায় না, বুঝিতেও পারে না, তেমনি ভাবে যাহারা বর্ব্বর তাহারা কবিতাগত ঐক্য দেখিতেও পায় না, বুঝিতেও পারে না। ইংরাজি সাহিত্য পড়িয়া আমার মনে হয় কবিতায় তুলনা ক্রমেই উন্নতিলাভ করিতেছে, যাহাদের মধ্যে ঐক্য সহজে দেখা যায় না তাহাদের ঐক্যও বাহির হইয়া পড়িতেছে। কবিতা বিজ্ঞান ও দর্শন ভিন্ন ভিন্ন পথ দিয়া চলিতেছে, কিন্তু একই জায়গায় আসিয়া মিলিবে ও আর কখন বিচ্ছেদ হইবে না।
যাহা হউক দেখা যাইতেছে সবই একাকার হইয়া পড়ে, জগৎটা না থাকিবার মতই হইয়া আসে। যাহা দেখিতেছি তাহা যে তাহাই নহে ইহাই ক্রমাগত মনে হয়। এই জন্যই জগৎকে কেহ কেহ মিথ্যা বলেন। কিন্তু আর এক রকম করিয়া জগৎকে হয়ত সত্য বলা যাইতে পারে।