ডুব দেওয়া

সত্য যাহা তাহা অদৃশ্য, তাহা কখন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নহে, তাহা একটা ভাব মাত্র। কিন্তু ভাব আমাদের নিকট নানারূপে প্রকাশ পায়, ভাষা আকারে, অক্ষর আকারে, বিবিধ বস্তুর বিচিত্র বিন্যাস আকারে। তেমনি প্রকৃত জগৎ যাহা তাহা অদৃশ্য, তাহা কেবল একটি ভাব মাত্র, সেই ভাবটি আমাদের চোখে বহির্জগৎরূপে প্রকাশিত হইতেছে। যেমন, যাহা পদার্থ নহে যাহা একটি শক্তি মাত্র তাহাকেই আমরা বিচিত্র বর্ণরূপে আলোকরূপে দেখিতেছি ও উত্তাপরূপে অনুভব করিতেছি, তেমনি যাহা একটি সত্যমাত্র তাহাকে আমরা বহির্জগৎরূপে দেখিতেছি। একজন দেবতার কাছে হয়তো এ জগৎ একেবারেই অদৃশ্য, তাঁহার কাছে আকার নাই, আয়তন নাই, গন্ধ নাই, শব্দ নাই, স্পর্শ নাই, তাঁহার কাছে কেবল একটা জানা আছে মাত্র। একটা তুলনা দিই। তুলনাটা ঠিক না হউক একটুখানি কাছাকাছি আসে। আমার যখন বর্ণপরিচয় হয় নাই, তখন যদি আমার নিকটে একখানা বই আনিয়া দেওয়া হয়—তবে সে বইয়ের প্রত্যেক আঁচড় আমার চক্ষে পড়ে, প্রত্যেক বর্ণ আলাদা আলাদা করিয়া দেখিতে পাই ও সমস্তটা অনর্থক ছেলেখেলা মনে করি। কিন্তু যখন পড়িতে শিখি, তখন আর অক্ষর দেখিতে পাই না। তখন বস্তুত বইটা আমার নিকটে অদৃশ্য হইয়া যায়, কিন্তু তখনি বইটা যথার্থতঃ আমার নিকটে বিরাজ করিতে থাকে। তখন আমি যাহা দেখি তাহা দেখিতে পাই না, আর-একটা দেখিতে পাই। তখন আমি বস্তুত দেখিলাম গ-য়ে আকার ছ (গাছ), কিন্তু তাহা না দেখিয়া দেখিলাম একটা ডালপালা-বিশিষ্ট উদ্ভিদ্‌ পদার্থ। কোথায় একটা কালো আঁচড় আর কোথায় একটা বৃহৎ বৃক্ষ! কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা বুঝিয়া পড়িতে পারি ততক্ষণ পর্যন্ত ঐ আঁচড়গুলা কি সমস্তই মিথ্যা নহে! যে ব্যক্তি শাদা কাগজের উপরে হিজিবিজি কাটে তাহাকে কি আমরা নিতান্ত অকর্মণ্য বলিব না! কারণ অক্ষর মিথ্যা। আমার একরূপ অক্ষর আর-একজনের আর-একরূপ অক্ষর। ভাষা মিথ্যা। আমার ভাষা এক তোমার ভাষা আর-এক। আজিকার ভাষা এক কালিকার ভাষা আর-এক। এ ভাষায় বলিলেও হয় ও ভাষায় বলিলেও হয়। গাছ বলিয়া একটা আওয়াজ শুনিলে আমি মনের মধ্যে যে জিনিষটা দেখিতে পাইব, আর একজন ব্যক্তি ট্রী বলিয়া একটা আওয়াজ না শুনিলে ঠিক সে জিনিষটা মনে আনিতে পারিবে না। অতএব দেখা যাইতেছে অক্ষর ও ভাষা তুমি ঘরে গড়িয়া বন্দোবস্ত করিয়া বদল করিতে পার কিন্তু তাহারি আশ্রিত ভাবটিকে খেয়াল অনুসারে বদল করা যায় না, তাহা ধ্রুব।

জগৎকে যে আমাদের মিথ্যা বলিয়া মনে হইতেছে, তাহার কারণ কি এমন হইতে পারে না যে, জগতের বর্ণপরিচয় আমাদের কিছুই হয় নাই। জগতের প্রত্যেক অক্ষর আঁচড়ের আকারে, সুতরাং মিথ্যা আকারে আমাদের চোখে পড়িতেছে। যখন আমরা বাস্তবিক জগৎকে পড়িতে পারিব তখন এ জগৎকে দেখিতে পাইব না। এ পড়া কি এক দিনে শেষ হইবে! এ বর্ণমালা কি সামান্য!

এ জগৎ মিথ্যা নয়, বুঝি সত্য হবে,
অক্ষর আকারে শুধু লিখিত রয়েছে।
অসীম হতেছে ব্যক্ত সীমা রূপ ধরি!

প্রেমের শিক্ষা

কিন্তু কে পড়াইবে! কে বুঝাইয়া দিবে যে জগৎ কেবল স্তূপাকৃতি কতকগুলো বস্তু নহে, উহার মধ্যে ভাব বিরাজমান? আর কেহ নহে, প্রেম। জগৎকে যে যথার্থ ভালবাসে সে কখন মনে করিতেও পারে না জগৎ একটা নিরর্থক জড়পিণ্ড। সে ইহারই মধ্যে অসীমের ও চিরজীবনের আভাস দেখিতে পায়। পূর্বে বলা হইয়াছে প্রেমেই যথার্থ স্বাধীনতা। কারণ, যতটা দেখা যায় প্রেমে তার চেয়ে ঢের বেশী দেখাইয়া দেয়।