প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
কবিদের কি কাজ এইবার দেখা যাইতেছে। সে আর কিছু নয়, আমাদের মনে সৌন্দর্য্য উদ্রেক করিয়া দেওয়া। উপদেশ দিয়া তত্ত্বনির্ণয় করিয়া প্রকৃতিকে মৃতদেহের মত কাটাকুটি করিয়া এ উদ্দেশ্য সাধন করা যায় না। সুন্দরই সৌন্দর্য্য উদ্রেক করিতে পারে। বৈষয়িকেরা বলেন ইহাতে লাভটা কি? কেবলমাত্র একটি সুন্দর ছবি পাইয়া, বা সুন্দর কথা শুনিয়া উপকার কি হইল? কি জানিলাম? কি শিক্ষা লাভ করিলাম? সঞ্চয়ের খাতায় কোন্ নূতন কড়িটা জমা করিলাম? কিছুক্ষণের মত আনন্দ পাইলাম, সে ত সন্দেশ খাইলেও পাই। ততক্ষণ যদি পাঁজি দেখিতাম, তবে আজকেকার তারিখ বার ও কবে চন্দ্রগ্রহণ হইবে সে খবরটা জানিতে পাইতাম।
বৈষয়িকেরা যাহাই বলুন-না কেন, আর কোন উদ্দেশ্যের আবশ্যক করে না, মনে সৌন্দর্য্য উদ্রেক করাই যথেষ্ট মহৎ। কবিতার ইহা অপেক্ষা মহত্তর উদ্দেশ্য আর থাকিতে পারে না। সৌন্দর্য্য উদ্রেক করার অর্থ আর কিছু নয়—হৃদয়ের অসাড়তা অচেতনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা, হৃদয়ের স্বাধীনতাক্ষেত্র প্রসারিত করিয়া দেওয়া। সে কার্য্যে যাঁহারা ব্রতী, তাঁহাদের সহিত একটি ময়রার তুলনা ঠিক খাটে না।
অতএব কবিদিগকে আর কিছুই করিতে হইবে না, তাঁহারা কেবল সৌন্দর্য্য ফুটাইতে থাকুন—জগতের সর্ব্বত্র যে সৌন্দর্য্য আছে তাহা তাঁহাদের হৃদয়ের আলোকে পরিস্ফুট ও উজ্জ্বল হইয়া আমাদের চোখে পড়িতে থাকুক, তবেই আমাদের প্রেম জাগিয়া উঠিবে, প্রেম বিশ্বব্যাপী হইয়া পড়িবে।
কবিরা যদি একটি তত্ত্ববিশেষকে সমুখে খাড়া করিয়া তাহারই গায়ের মাপে ছাঁট-ছোঁট করিয়া কবিতার মেরজাই ও পায়জামা বানাইতে থাকেন, ও সেই পোষাকে সুসজ্জিত করিয়া তত্ত্বকে সমাজে ছাড়িয়া দেন, তবে সে তত্ত্বগুলিকে কেমন খোকাবাবুর মত দেখায় ও সে কাজটাও ঠিক কবির উপযুক্ত হয় না। এক-একবার এমন দর্জ্জীবৃত্তি করিতে দোষ নাই, এবং মোটা মোটা বয়স্ক তত্ত্বেরা যদি মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান-বিশেষের সময়ে তাঁহাদের থানধুতি ছাড়িয়া এইরূপ পোষাক পরিয়া সভায় আসিয়া উপস্থিত হন তাহাতেও তেমন আপত্তি দেখি না। কিন্তু এই যদি প্রথা হইয়া পড়ে, কবিতাটি দেখিলেই যদি দশজনে পড়িয়া তাহার খোলা ও শাঁস ছাড়াইয়া ফেলিয়া তাহা হইতে তত্ত্বের আঁটি বাহির করাই প্রধান কর্ত্তব্য বিবেচনা করেন, তাহা হইলে নিশ্চয়ই ক্রমে এমন ফলের চাষ হইতে আরম্ভ হইবে, যাহার আঁটিটাই সমস্ত, এবং যে সকল ফলের মধ্যে আঁটির বাহুল্য থাকিবে না শাঁস এবং মধুর রসই অধিক, তাহারা নিজের আঁটিদরিদ্র অস্তিত্ব ও মাধুর্য্য-রসের আধিক্য লইয়া নিতান্ত লজ্জা অনুভব করিবে। তখন গহনা-পরা গরবিনীকে দেখিয়া ভুবনমোহিনী রূপসীরাও ঈর্ষ্যাদগ্ধ হইবে।
তত্ত্ব অর্থাৎ জ্ঞান পুরাতন হইয়া যায়, মৃত হইয়া যায়, মিথ্যা হইয়া যায়। আজ যে জ্ঞানটি নানা উপায়ে প্রচার করিবার আবশ্যক থাকে, কাল আর থাকে না, কাল তাহা সাধারণের সম্পত্তি হইয়া গিয়াছে। কাল যদি পুনশ্চ সে কথা উত্থাপন করিতে যাও