নিন্দা-তত্ত্ব
আরম্ভ করলে তুমি বল যে, 'নাঃ, কিছু না' এমন স্বরে বল যে, তার অর্থ এই হয়ে দাঁড়ায় যে, 'সে অনেক কথা!' আর-এক রকম নিন্দে আছে, তাকে বাজে নিন্দে বা উপরি নিন্দে বলা যেতে পারে। সে হচ্ছে, পাঁচ কথা বলতে বলতে এক কথা বলা। রামধনবাবুর কাল রাত্রে অত্যন্ত কাশি হয়েছিল, এই গল্পটি বলবার সময় একটু সুবিধে, অবকাশ ও ছিদ্র পেলেই, সুদক্ষ নিন্দুক যেন বিশেষ কোনো কথা নয় এমনি ভাবে হরকুমার যে মদ খায় সেই কথাটা সংক্ষেপে বলে যান। গানের পক্ষে যেমন তান, গল্পের পক্ষে এরকম নিন্দাও তাই। যেমন গানের সুর ও তাল বজায় রেখে দুই-একটা বাজে তান দিলে হানি নেই, গানের সুর বিগড়ে বা তাল মাটি করে একটা অসংলগ্ন তান দিলে শ্রোতাদের কানে ভালো শোনায় না, তেমনি গল্পের তাল বজায় রেখে ঠিক জায়গায় একটা উপরি কথা তুললে শ্রোতাদের মন্দ লাগে না; এরকম স্থলে বক্তার নিন্দুক বলে বদনাম রটে না; মনে হয় পাঁচ কথা বলতে এক কথা দৈবাৎ বেরিয়ে পড়ল। বেকন-এ আছে, যে, এক-একজন বাজে কথায় চিঠি পুরিয়ে কাজের কথা পুনশ্চ নিবেদনের মধ্যে লেখেন। অনেক নিন্দুকও তাই করেন, সমস্ত কথার মধ্যে যে নিন্দাটা তাঁর বিশেষ বলা উদ্দেশ্য সেইটেকে তিনি এমন অপ্রাধান্য দিয়ে বলেন যে, মনে হয় যেন, সেটা বলবার জন্যে তাঁর বিশেষ মাথা- ব্যথা পড়ে নি। আবার অনেকে ভান করেন যেন, দৈবাৎ তিনি এক কথা বলে ফেললেন, আধখানা বলেই জিব কামড়ান, তার পরে পাড়াপীড়ির পর অতি আস্তে আস্তে সব বের করে ফেলেন। লোকে বলবে তিনি ইচ্ছে করে পারতপক্ষে কারো নিন্দে করেন নি। কেউ বা, যেন তিনি মনে করছেন যে তুমি তো জানোই, এমনিভাবে তোমার কাছে একটা কথা বলে ফেলেন; তার পরে যখন শোনেন যে, তুমি জানতে না, তখন ঘোরতর অনুতাপ আফসোস করতে আরম্ভ করেন। আবার অনেকে নিন্দে করবার সময় এইরকম ভাব দেখান যে, যেন 'সকলেই এ কথা জানে, তুমি জান না, এ ভারি আশ্চর্য!' এ-সকল নিন্দে নিন্দের নামে সংসারে গণ্য হয় না। সংসারে আর-এক প্রকারের নিন্দা আছে, তাকে আত্ম-নিন্দা বলতে গেলে সকল সময়ে বিনয় বোঝায় না। অধিকাংশ আত্ম-নিন্দা গর্ব থেকে উত্থিত হয়। তুমি সমস্ত সমাজকে উপেক্ষা করে বলতে থাকো যে, আমি পৃথিবীর নিন্দা গ্রাহ্য করি নে! আমি অমুক অমুক পাপাচরণ করেছি, এখন সমাজ! তুমি আমার কী করতে পারো করো। সমাজের উপর মহা খাপা! কেন? না সমাজের শক্তি আছে বলে। পাপাচরণ করলে সমাজ বলপূর্বক শাসন করেন বলে। সমাজের দুই-একটি আদুরে ছেলে ছাড়া আর কেউ বিপথে গেলে সমাজ তাকে স্নেহের স্বরে উপদেশ দেন না, তাকে কান ধরে সিধা পথে আনেন। আদরের ও স্নেহের দানা দেখিয়ে তিনি ছিন্ন-রজ্জু ঘোড়াকে আস্তাবলে ফেরাতে চেষ্টা করেন না, তাঁর নিয়ম হচ্ছে চাবুকের ভয় দেখানো। কিন্তু এক-একটা মানুষ আছে, যাদের মন্দ কাজ না করতে অনুরোধ করো, শুনবে, কিন্তু আদেশ করো, অমনি তার বিরুদ্ধে তারা কোমর বেঁধে দাঁড়াবে। আত্ম-নিন্দুক দলেরা অধিকাংশ এই শ্রেণীর লোক। বায়রন তার একটি বিখ্যাত আদর্শ। পর- নিন্দুকদের মতো আত্ম-নিন্দুকদের সকল কথাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। আত্মনিন্দা যখন গর্ব থেকে উত্থিত হচ্ছে, তখনও তা অনেক পীড়াপীড়িতে দায়ে পড়ে স্বীকার করা হয়, তখন যে তার অনেক কথা বাড়ানো থাকা সম্ভব, তা বলাই বাহুল্য। এইরকম সমাজের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করে তারা দুর্দান্ত বলিষ্ঠ-হৃদয় লোক। কিন্তু একটা দেখা যায়, এক ব্যক্তির সমাজ-বিদ্রোহিতা যতই বলবান হোক-না কেন, তবু এতটুকু আত্মশ্লাঘা ও নিন্দা-ভীরুতা তার মনে অবশিষ্ট থাকবে যে, কতকগুলি ছোটোখাটো দোষ সে সমাজের কাছে কোনো মতেই প্রকাশ করতে রাজি হবে না। একজন মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতে পারবে যে, সে ডাকাতি করেছে, কিন্তু চুরি করেছে স্বীকার করতে সে কুণ্ঠিত হবে। কিন্তু এমন যদি কেউ থাকে যে, তার হৃদয়ের-বীভৎসতম স্থান পর্যন্ত লোকের চক্ষে অনাবৃত করে দিতে পারে, এমন কোনো পাপ পৃথিবীতে নেই যা সে প্রকাশ্যভাবে আপনার স্কন্ধে না নিতে পারে, তবে সে নরকের এক খণ্ড। পাপ যে করে সে বিকৃত-চরিত্র, কিন্তু যে প্রকাশ্যভাবে পাপ করে সে সে-বিশেষণের অনধিগম্য। আত্ম-নিন্দা ও বিনয় কেউ যেন এক পদার্থ মনে না করেন। বাংলা এক মহাকাব্যে মহাকবি রামের মুখে অনেক স্থলে 'ভিখারী' বলে আত্মপরিচয় বসিয়েছেন। যেমন 'ভিখারী রাঘব; দূতি, বিদিত জগতে!' বোধ হয় কবি রামকে বিনয়ী করবার অভিলাষে এইরকম করে থাকবেন, কিন্তু আমরা একে বিনয় বলতে পারি নে। 'আমি দরিদ্র' এ কথা বিনয়ে বলা যেতে পারে,