তার্কিক

যুক্তির মানে কি? যোজনা করা ত? একটার সঙ্গে আর একটার যোগ করা। পতনের সঙ্গে হাত পা ভাঙ্গার যোগ আছে, সুতরাং পতনের পর হাত পা ভাঙ্গা যুক্তিসিদ্ধ। চুপ করিয়া বসিয়া থাকিলে যে হাত পা ভাঙ্গিবে ইহা যুক্তিসিদ্ধ নহে, কারণ, এই কার্য্যকারণের মধ্যে একটা যোগ পাওয়া যায় না। কিন্তু একটু ভাবিলেই দেখা যায়, আমরা কেবল কতকগুলি ঘটনাই দেখিতে বা জানিতে পাই, কোন্‌ কার্য্যকারণের যোগ আমাদের চোখে পড়ে! ঈথর-নামক সূক্ষ্ম পদার্থে ঢেউ উঠিলে আমরা যে আলো দেখিতে পাই, ইহার যুক্তি কি? এ দুইটি ঘটনার মধ্যে যোগ কোথায়? আমাদের মস্তিষ্কের কতকগুলি পরমাণু ঘোরার সঙ্গে আমাদের স্মৃতির, ভাবনার,মনোবৃত্তির কি যোগ থাকিতে পারে? এমন কি কার্য্যকারণশৃঙ্খলা আছে যাহার পদে পদে missinglinks নাই? এই ত তোমার যুক্তি! এই তৃণটি ধরিয়া তুমি অনন্ত-নামক অকূল অতলস্পর্শ সমুদ্রে কি বলিয়া ভাসিতে চাও! যুক্তির গোটা-কতক কাজ আছে তার আর ভুল নাই, কিন্তু তাই বলিয়া ঐ দাম্ভিকটা যে যেখানে-সেখানে মোড়লি করিয়া বেড়াইবে সে কাহার প্রাণে সয়? তার নিজের কাজই ঢের বাকি পড়িয়া আছে, পরের কাজে ব্যাঘাত করিয়া সময় নষ্ট করিবার আবশ্যক?

জগতের যেমন এক দিকে সীমা আর-এক দিকে অনন্ত, এক দিকে তীর আর-এক দিকে সমুদ্র, আমাদের মনেরও তেমনি এক দিকে সীমা আর-এক দিকে অসীম; সীমার রাজ্যে যুক্তির শাসন, অতএব সে রাজ্যে যুক্তির শাসন লঙ্ঘন করিলে পদে পদে তাহার ফল ভোগ করিতে হয়। কিন্তু যখনি অসীমের রাজ্যে পদার্পণ করিলাম তখনি আমরা আর যুক্তির প্রজা নহি – অতএব হে বন্ধু, হে তার্কিক, আমি যখন অসীমের রাজ্যে আছি তখন আমাকে যুক্তির আইনের ভয় দেখাইলে আমি মানিব কেন?

তাই বলিতেছি, তুমি যে কথায় কথায় আমার সঙ্গে তর্ক করিতে আইস, সেটা আমার ভাল লাগে না, এবং তাহাতে কোন কাজও হয় না। তুমি আমি একত্র থাকাটাই অযৌক্তিক, কারণ তোমাতে আমাতে কোন যোগই নাই! তোমাকে আমি হীন বলিতেছি না, তুমি হয়ত মস্ত লোক, তুমি হয়ত রাজা, কিন্তু শার্‌ঙ্গরব দুষ্যন্তকে যেরূপ চক্ষে দেখিয়াছিলেন আমিও হয়ত তোমাকে সেইরূপ চক্ষে দেখিব: অভ্যক্তমিব স্নাতঃ শুচিরশুচিমিব, প্রবুদ্ধ ইব সুপ্তম্‌ ইত্যাদি। যুক্তির সৈন্য লইয়া তুমি তোমার নিজ রাজ্যে একজন দোর্দ্দণ্ডপ্রতাপ লোক, উহারই সাহায্যে তুমি কত রাজ্য অধিকার করিলে, কত রাজ্য ধ্বংস করিলে, কিন্তু আমার বিস্তৃত রাজ্যের এক তিলও তুমি কাড়িয়া লইতে পার না। তুমি আমাকে হাজার চোখ রাঙাও-না কেন আমি ডরাই না। আমার অধিকারে আসিবার ক্ষমতা তুমি হারাইয়াছ, কিন্তু তোমার অধিকারে আমি অনায়াসেই যাইতে পারি। তোমাতে আমাতে বিস্তর প্রভেদ।

আমার তার্কিক বন্ধু এই বলিয়া আমার নিন্দা করেন যে, আমি এক সময়ে যাহা বলিয়াছি আর-এক সময়ে তাহার বিপরীত কথা বলি– সে কথাটা ঠিক। কিন্তু তাহার একটা কারণ আছে। আমি যা বলি তাহা প্রাণের ভিতর হইতে বলি, যুক্তি অযুক্তি খতাইয়া হিসাবপত্র করিয়া বলি না। আমি যাহার কথা বলি, মমতার প্রভাবে তাহার সহিত একবারে মিশাইয়া যাই। সুতরাং কেবলমাত্র তাহার কথাই বলি, তাহার উল্টা দিকের কথাটা বলি না। প্রকৃতিতেও তাহাই হয়। প্রকৃতির দিন প্রকৃতির রাত্রের বিপরীত কথা বলিয়া থাকে, প্রকৃতির পূর্ব্বদিক প্রকৃতির পশ্চিমদিকের কথা বলে না। প্রকৃতির পদে পদে বিরোধী উক্তি দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু তাহারা কি বাস্তবিকই বিরোধী? তাহারা দুই বিপরীত সত্য। আমি আলো হইয়া আলোর কথা বলি, অন্ধকার হইয়া অন্ধকারের কথা বলি। আমার দুটা কথাই সত্য। আমি কিছু এমন প্রতিজ্ঞা করিয়া বসি নাই যে একেবারে বিরোধী কথা বলিব না; যে ব্যক্তি কোন কালে বিরোধী কথা বলে নাই তাহার বুদ্ধি ত জড়পদার্থ, তাহার কোন কথার কোন মূল্য আছে কি? আমরা যে বিরোধের মধ্যেই বাস করি। আমাদের অদ্য আমাদের কল্যকার বিরোধী, আমাদের বৃদ্ধকাল আমাদের বাল্যকালের বিরোধী; সকালে যাহা সত্য বিকালে তাহা সত্য নহে। এত বিরোধের মধ্যে থাকিয়াও যাহার কথার পরিবর্ত্তন হয় না, যাহার মত অবিরোধে থাকে, তাহার বুদ্ধিটা ত একটা কলের পুতুল, যত বার দম দিবে তত বার একই নাচন নাচিবে।

উপসংহারে আর গুটি দুই কথা বলিযা শেষ করি।