চীনে মরণের ব্যবসায়
বিশেষরূপে অনুরোধ করিলেন।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হ্বাম্পোয়ো হইতে তাঁহাদের জাহাজ সরাইয়া লিন্‌-টিন দ্বীপে লইয়া গেলেন। চীনের সমস্ত উপকূল পর্যটন করিবার জন্য জাহাজ প্রেরিত হইল। সেই-সকল জাহাজ হইতে কিছু দূরে অন্যান্য অহিফেন সমেত জাহাজ সঙ্গে সঙ্গে ভ্রমণ করিতে লাগিল। সেই জাহাজসমূহ হইতে অহিফেন লইয়া লুকাইয়া চুরাইয়া বেআইনি বাণিজ্য চলিতে লাগিল। দেশের অভ্যন্তর ভাগে লোকদের মধ্যে এই নেশা প্রচলিত করাইবার জন্য চীন রাজকর্মচারীদের ইংরাজেরা প্রায় মাঝে মাঝে ঘুষ দিতে লাগিল। ক্রিস্ট্‌লিয়েব্‌ বলিতেছেন যে, এইরূপ পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া ভারতবর্ষীয় ইংরাজ গবর্নমেন্ট চীনবাসীদের নিজ দেশের আইন লঙ্ঘন করিতে ও উপরিস্থ ব্যক্তিদিগের অবাধ্য হইতে যেরূপ শিক্ষা দিয়াছেন, এমন আর কেহ দেয় নাই।

১৮৩৪ খৃস্টাব্দে অহিফেন বাণিজ্যের বিরুদ্ধে নূতন শাসন প্রচারিত হইল। কিন্তু তথাপি গোপন ব্যবসায় এতদূর পর্যন্ত বাড়িয়া উঠিল যে, সমস্ত চীন দেশে অহিফেন লইয়া একটা আন্দোলন উপস্থিত হইল। চীনের দেশ-হিতৈষীরা ইংরাজদের সহিত সমস্ত বাণিজ্য রদ করিবার প্রস্তাব করিলেন। প্রজাদিগের ঘোর অনিষ্ট সম্ভাবনা দেখিয়া সম্রাট ব্যাকুল হইয়া প্রতিনিধিস্বরূপ লিন্‌কে ক্যান্টনে প্রেরণ করিলেন। লিন্‌ বন্দরস্থিত জাহাজের সমস্ত অহিফেন ধ্বংস করিয়া দিলেন, ইংরাজদের সহিত বাণিজ্য রহিত করিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সমস্ত কর্মচারীকে চীন হইতে দূর করিয়া দিলেন। অবশেষে ইংরাজদের সহিত যুদ্ধ বাধিল।

যুদ্ধের ফল সকলেই অবগত আছেন। পরাজিত চীন সন্ধি করিল। পাঁচটি বন্দর ইংরাজ বণিকদের নিকটে উন্মুক্ত হইল, হংকং ইংরাজেরা লাভ করিলেন, এবং ২১ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ স্বরূপে চীনের নিকট হইতে আদায় করিলেন। ইংরাজেরা অনুগ্রহ করিয়া সন্ধিপত্রে সম্মতি দিলেন যে, 'বেআইনী সমস্ত পণ্যদ্রব্য চীন গবর্নমেন্ট কাড়িয়া লইতে পারিবেন।' এই অবসরে ইংরাজেরা চেষ্টা করিয়াছিলেন যাহাতে অহিফেন বেআইনী পণ্যের মধ্যে গণ্য না হয়। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয় নাই। ইংরাজ প্রতিনিধি সার্‌ পটিঞ্জরকে চীন কর্তৃপক্ষীয়েরা অহিফেন বাণিজ্য একেবারে উঠাইয়া দিতে সাহায্য করিবার জন্য অনুরোধ করিলেন। তিনি কহিলেন, 'আচ্ছা, জাহাজে অহিফেন দেখিলে কাড়িয়া লইয়ো, তাহাতে আমাদের আপত্তি নাই, তবে আমরা তোমাদের সাহায্য করিতে পারিব না।' তিনি বিলক্ষণ অবগত ছিলেন যে, অহিফেন-বাণিজ্যতরীসকল যুদ্ধ-সজ্জায় যেরূপ সুসজ্জিত, তাঁহাদের সাহায্য ব্যতীত দুর্বল চীন তাহাদের কাছে ঘেঁষিতে পারিবে না। এইরূপে প্রকাশ্যভাবে, অসহায় চীনের চোখের সামনে বেআইনী ব্যবসায় চলিতে লাগিল।

বিদেশীয়েরা উপর্যুপরি ও অবিরত তাহাদের দেশের আইন লঙ্ঘন করাতে চীনবাসীরা এত ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল যে, 'লোহিত-কেশ' বিদেশীদের একেবারে বিনাশ করিতে তাহারা কল্পনা করিল। রাজকর্মচারী ইয়েঃ 'অ্যারো' নামক একটি ইংরাজ-জাহাজ ধৃত করাতে পুনর্বার চীনদের সহিত ইংরাজদের যুদ্ধ বাধিল। এবারে ফ্রান্স ইংলন্ডের সহিত যোগ দিলেন।

হতভাগ্য পরাজিত চীনকে সাতটি বন্দর বিদেশীদের নিকট উন্মুক্ত করিতে হইল। অহিফেন বেআইনী পণ্যের মধ্যে আর পরিগণিত হইল না। কেবল অহিফেনের উপর মাশুল নির্দিষ্ট হইল। যাহাতে মাশুল গুরুতর হয় চীনেরা তাহার জন্য বারংবার নিবেদন করে, কিন্তু ইংরাজরা তাহা অগ্রাহ্য করিয়াছে। এইবারের সন্ধির পর হইতে অহিফেনের বাণিজ্য এমন শ্রীবৃদ্ধি লাভ করিল যে, ১৮৭৫ খৃস্টাব্দে চীনে ৯০০০০ বাক্স অহিফেন আমদানি হইয়াছে।

এখন চীনে কোটি কোটি লোক অহিফেন সেবন করিতেছে। আমাদের দেশে যেমন বাড়িতে কেহ আসিলে আমরা তামাক দিই, চীনে সেইরূপ ধনী লোকেরা ও শ্রীসম্পন্ন ব্যবসায়ীরা প্রায় সাক্ষাৎকারীদের ও খরিদ্দারদের চণ্ডুর হুঁকা দিয়া থাকে। রাস্তায় রাস্তায় চণ্ডুর দোকান খুলিয়াছে। ঙ্গ্যানিহিয়েন নগরে অহিফেন-ধূম সেবনের এমন প্রাদুর্ভাব হইয়াছে যে, অধিবাসীরা নেশায় ভোর হইয়া দিনের বেলায় কোনো কাজ করিতে পারে না, মশাল জ্বালাইয়া রাত্রে কাজ করে। এক নিংপো নগরে কেবল দরিদ্র লোকদিগের জন্য ২৭০০ চণ্ডুর দোকান আছে। দেখা গিয়াছে যে যে স্থানে অহিফেন সেবনের বিশেষ প্রাদুর্ভাব, সেই সেই স্থানে দুর্ভিক্ষের প্রভাব