চীনে মরণের ব্যবসায়
অত্যন্ত অধিক হয়। প্রথম কারণ, লোকেরা অকর্মিষ্ঠ, দ্বিতীয় কারণ, এত অধিক জমি অহিফেনের চাষে নিয়োজিত যে, যথেষ্ট পরিমাণে শস্য উৎপাদনের স্থান নাই। এমন হইয়াছে দুর্ভিক্ষের সময় লোকের হাতে টাকা আছে, অথচ তাহারা টাকা খুঁজিয়া পায় না। তখন তাহারা বুঝিয়াছে যে, অহিফেনে পেট ভরে না। চীনবাসীরা ক্রমশই অকর্মণ্য হইয়া যাইতেছে। ১৮৩২ খৃস্টাব্দে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যখন এক হাজার সৈন্য প্রেরিত হয়, তাহার মধ্য হইতে দুইশত অহিফেনসেবী অকর্মণ্য সৈন্য ফেরত পাঠাইতে হইয়াছিল। বিদ্রোহী দলের মধ্যে সকলেই অহিফেন- বিদ্বেষী ছিল, অহিফেনসেবী রাজসৈনিকেরা তাহাদের নিকটে উপর্যুপরি পরাজিত হয়। চীনেরা বলে যে, সহজে চীনদেশ জয় করিবার অভিপ্রায়ে ধূর্ত ইংরাজেরা অহিফেন ব্যবসায় চীনে প্রচলিত করিয়াছে। অহিফেনের জন্য প্রতি বৎসর চীনদেশ হইতে এত টাকা বাহির হইয়া যায় যে, ক্রমশই সে দরিদ্র হইয়া পড়িতেছে। ১৮৭২ খৃস্টাব্দে চীন ৮ কোটি ২ লক্ষ ৬১ হাজার ৩ শত ৮১ পাউন্ড অহিফেন কিনিয়াছে! কী ভয়ানক ব্যয়! অহিফেনসেবীদের নীতি এমনি বিগড়িয়া যায় যে, তাহারা নিজের সন্তান বিক্রয় করে ও নিজের স্ত্রীকে ভাড়া দেয়, চুরি-ডাকাতির তো কথাই নাই। এইরূপে এক বিদেশীয় জাতির হীন স্বার্থপরতা ও সীমাশূন্য অর্থলিপ্সার জন্য সমস্ত চীন তাহার কোটি কোটি অধিবাসী লইয়া শারীরিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অধঃপতনের পথে দ্রুতবেগে ধাবিত হইতেছে। যেন, ইংরাজদিগের নিকট ধর্মের অনুরোধ নাই, কর্তব্যঞ্চানের অনুরোধ নাই, সহৃদয়তার অনুরোধ নাই, কেবল একমাত্র পয়সার অনুরোধ বলবান। এই তো তাঁহাদের ঊনবিংশ শতাব্দীর খৃস্টীয় সভ্যতা!

পাদ্রিদিগের ধর্মোপদেশ শুনিলে চীনবাসীদের গা জ্বলিয়া যায়। জ্বলিবার কথাই তো বটে! একবার একজন আমেরিকান পাদ্রি কাইফংফু নগরে গিয়াছিলেন, সেখানে একদল লোক জুটিয়া তাঁহাকে দূর করিয়া দেয়। তাহারা তাঁহাকে বলে, 'তোমরা আমাদের সম্রাটকে হত্যা করিলে, আমাদের রাজপ্রাসাদ ভূমিসাৎ করিলে, আমাদের ধ্বংস করিবার জন্য বিষ আনয়ন করিলে, আর আজ আমাদের ধর্ম শিখাইতে আসিয়াছ!!' একজন ইংরাজ ফাট্‌সান নগরে চণ্ডুর দোকান দেখিতে গিয়াছিলেন, একজন চণ্ডুপায়ী তাঁহার কাছে স্বীকার করিয়াছিল যে, সে তাহার দৈনিক উপার্জনের দশ ভাগের আট ভাগ চণ্ডুপান করিয়া ব্যয় করে। সে অবশেষে ইংরাজটিকে বলে, 'তুমি তো ইংলন্ড হইতে আসিতেছ? তাহা হইলে অবশ্য তুমি আমাদের মৃত্যুর নিদান বিষ লইয়া কারবার করিয়া থাক। আচ্ছা, তোমাকে জিজ্ঞসা করি, তোমাদের রানীটি না জানি কীরূপ দুষ্ট স্ত্রীলোক! আমরা তোমাদের ভালো ভালো চা ও রেশম পাঠাই, আর তিনি কি না তাহার পরিবর্তে আমাদের বধ করিবার জন্য বিষ পাঠাইয়া দেন?' ইংরাজদের সম্বন্ধে চীনেরা এইরূপ বলে।

এই এক অহিফেন ব্যবসায় সম্বন্ধে বিদেশীয়দের প্রতি চীনের এতদূর অবিশ্বাস হইয়াছে যে, তাহারা স্বদেশে রেলোয়ে প্রভৃতি নির্মাণ করিতে চাহে না, পাছে অহিফেন দেশের অভ্যন্তরদেশে অধিক করিয়া প্রবেশ করিতে পারে। পাছে বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি হয় ও তৎসঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত পরিমাণে বিদেশীদের আমদানি হয়! এমন-কি, লৌহ ও কয়লার খনি ব্যতীত দেশের অন্যান্য বড়ো বড়ো খনি চীন গবর্নমেন্ট স্পর্শ করেন না, পাছে খনিতে বিদেশীয় কর্মচারী রাখিতে হয় ও পাছে বিদেশীয় বাণিজ্য আরও বাড়িয়া উঠে। অহিফেনে চীনের রাজস্বলাভ বড়ো অল্প হয় না, তথাপি চীন জোড় হস্তে বলে, 'তোর ভিক্ষা দিয়া কাজ নাই, তোর কুকুর ডাকিয়া লঞ্চ!' পটিঞ্জর যখন অহিফেনকে নিষিদ্ধ পণ্য-শ্রেণী-বহির্ভূত করিতে সম্রাটের নিকট প্রস্তাব করেন, তখন সম্রাট টাও ক্বাং এই কথা বলিয়াছিলেন, 'সত্য বটে, এ বিষের সঞ্চরণ আমি কোনো মতে রোধ করিতে পারিব না, কারণ অর্থলোলুপ, নীতিভ্রষ্ট লোকেরা লোভ ও ইন্দ্রিয়াসক্তির বশ হইয়া আমার মনের ইচ্ছা বিপর্যস্ত করিয়া দিবে। তথাপি আমি বলিতেছি-- আমার নিজের প্রজাদের পাপ ও যন্ত্রণা হইতে যে আমি রাজস্ব লাভ করিব, এমন প্রবৃত্তি আমার কিছুতেই হইবে না!'

ইংরাজ জাতির প্রতি চীনের এইরূপ দারুণ অবিশ্বাস থাকাতে ইংরাজদের কম লোকসান হইতেছে না। চীনে ইংরাজ-বাণিজ্যের অত্যন্ত ক্ষতি হইতেছে। ইংরাজি পণ্য চীনে অল্প আমদানি হয়, এবং তাহা দেশের অভ্যন্তর ভাগে চালান করিতে অত্যন্ত কষ্ট পাইতে হয়। অল্প দিন হইল লন্ডন ব্যাঙ্ক-ওয়ালারা চীনে ইংরাজ-বাণিজ্যের শোচনীয় অবস্থা বিষয়ে গবর্নমেন্টের নিকট এক দরখাস্ত