সঙ্গীত ও কবিতা
সাহায্য অবলম্বন করিতে হয়। গোলাপের সৌন্দর্য্য আমি যে উপভোগ করিতেছি তাহা এমন করিয়া প্রকাশ করিতে হয়, যাহাতে তোমার মনেও সে সৌন্দর্য্যভাবের উদ্রেক হয়। এইরূপ প্রকাশ করাকেই বলে কবিতা। চোখে চোখে চাহনির মধ্যে যে যুক্তি আছে, যাহাতে করিয়া প্রেম ধরা পড়ে– অতিরিক্ত যত্ন করার মধ্যে যে যুক্তি আছে, যাহাতে করিয়া প্রেমের অভাব ধরা পড়ে- কথা না কহার মধ্যে যে যুক্তি আছে, যাহাতে অসীম কথা প্রকাশ করে – কবিতা সেই-সকল যুক্তি ব্যক্ত করে।

সচরাচর কথোপকথনে যুক্তির যতটুকু আবশ্যক তাহারই চূড়ান্ত আবশ্যক দর্শনে বিজ্ঞানে। এই নিমিত্ত দর্শন বিজ্ঞানের গদ্য কথোপকথনের গদ্য হইতে অনেক তফাৎ। কথোপকথনের গদ্যে দর্শন বিজ্ঞান লিখিতে গেলে যুক্তির বাঁধুনি আল্‌গা হইয়া যায়। এই নিমিত্ত খাঁটি নিভাঁজ যুক্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করিবার জন্য এক প্রকার চুল-চেরা তীক্ষ্ম পরিষ্কার ভাষা নির্ম্মাণ করিতে হয়। কিন্তু তথাপি সে ভাষা গদ্য বৈ আর কিছু নয়। কারণ, যুক্তির ভাষাই নিরলঙ্কার সরল পরিষ্কার গদ্য।

আর, আমরা সচরাচর কথোপকথনে যতটা অনুভাব প্রকাশ করি তাহারই চূড়ান্ত প্রকাশ করিতে হইলে কথোপকথনের ভাষা হইতে একটা স্বতন্ত্র ভাষার আবশ্যক করে। তাহাই কবিতার ভাষা– পদ্য। অনুভাবের ভাষাই অলঙ্কারময়, তুলনাময় পদ্য। সে আপনাকে প্রকাশ করিবার জন্য আঁকুবাঁকু করিতে থাকে – তাহার যুক্তি নাই, তর্ক নাই, কিছুই নাই। আপনাকে প্রকাশ করিবার জন্য তাহার তেমন সোজা রাস্তা নাই। সে নিজের উপযোগী নূতন রাস্তা তৈরি করিয়া লয়। যুক্তির অভাব মোচন করিবার জন্য সৌন্দর্য্যের শরণাপন্ন হয়। সে এমনি সুন্দর করিয়া সাজে যে, যুক্তির অনুমতিপত্র না থাকিলেও সকলে তাহাকে বিশ্বাস করে। এমনি তাহার মুখখানি সুন্দর,যে, কেহই তাহাকে “কে” “কি বৃত্তান্ত” “কেন” জিজ্ঞাসা করে না, কেহ তাহাকে সন্দেহ করে না, সকলে হৃদয়ের দ্বার খুলিয়া ফেলে, সে সৌন্দর্য্যের বলে তাহার মধ্যে প্রবেশ করে। কিন্তু নিরলঙ্কার যৌক্তিক সত্যকে প্রতি পদে বহুবিধ প্রমাণ-সহকারে আত্মপরিচয় দিয়া আত্মস্থাপনা করিতে হয়, দ্বারীর সন্দেহভঞ্জন করিতে হয়, তবে সে প্রবেশের অনুমতি পায়। অনুভাবের ভাষা ছন্দোবদ্ধ। পূর্ণিমার সমুদ্রের মত তালে তালে তাহার হৃদয়ের উত্থান পতন হইতে থাকে, তালে তালে তাহার ঘন ঘন নিশ্বাস পড়িতে থাকে। নিশ্বাসের ছন্দে, হৃদয়ের উত্থানপতনের ছন্দে তাহার তাল নিয়মিত হইতে থাকে। কথা বলিতে বলিতে তাহার বাধিয়া যায়, কথার মাঝে মাঝে অশ্রু পড়ে, নিশ্বাস পড়ে, লজ্জা আসে, ভয় হয়, থামিয়া যায়। সরল যুক্তির এমন তাল নাই, আবেগের দীর্ঘনিশ্বাস পদে পদে তাহাকে বাধা দেয় না। তাহার ভয় নাই, লজ্জা নাই, কিছুই নাই। এই নিমিত্ত, চূড়ান্ত যুক্তির ভাষা গদ্য, চূড়ান্ত অনুভাবের ভাষা পদ্য।

আমাদের ভাবপ্রকাশের দুটি উপকরণ আছে– কথা ও সুর। কথাও যতখানি ভাব প্রকাশ করে, সুরও প্রায় ততখানি ভাব প্রকাশ করে। এমন-কি, সুরের উপরেই কথার ভাব নির্ভর করে। একই কথা নানা সুরে নানা অর্থ প্রকাশ করে। অতএব ভাবপ্রকাশের অঙ্গের মধ্যে কথা ও সুর উভয়কেই পাশাপাশি ধরা যাইতে পারে। সুরের ভাষা ও কথার ভাষা উভয় ভাষায় মিশিয়া আমাদের ভাবের ভাষা নির্ম্মাণ করে। কবিতায় আমরা কথার ভাষাকে প্রাধান্য দিই ও সঙ্গীতে সুরের ভাষাকে প্রাধান্য দিই। যেমন, কথোপকথনে আমরা যে-সকল কথা যেরূপ শৃঙ্খলায় ব্যবহার করি, কবিতায় আমরা সে-সকল কথা সেরূপ শৃঙ্খলায় ব্যবহার করি না – কবিতায় আমরা বাছিয়া বাছিয়া কথা লই, সুন্দর করিয়া বিন্যাস করি–তেমনি কথোপকথনে আমরা যে-সকল সুর যেরূপ নিয়মে ব্যবহার করি সঙ্গীতে সে- সকল সুর সেরূপ নিয়মে ব্যবহার করি না, সুর বাছিয়া লই, সুন্দর করিয়া বিন্যাস করি। কবিতায় যেমন বাছা বাছা সুন্দর কথায় ভাব প্রকাশ করে, সঙ্গীতেও তেমনি বাছা বাছা সুন্দর সুরে ভাব প্রকাশ করে। যুক্তির ভাষায় প্রচলিত কথোপকথনের সুর ব্যতীত আর কিছু আবশ্যক করে না। কিন্তু যুক্তির অতীত আবেগের ভাষায় সঙ্গীতের সুর আবশ্যক করে। এ বিষয়েও সঙ্গীত অবিকল কবিতার ন্যায়। সঙ্গীতেও ছন্দ আছে। তালে তালে তাহার সুরের লীলা নিয়মিত হইতেছে। কথোপকথনের ভাষায় সুশৃঙ্খল ছন্দ নাই, কবিতায় ছন্দ আছে, তেমনি কথোপকথনের সুরে সুশৃঙ্খল তাল নাই, সঙ্গীতে তাল আছে। সঙ্গীত ও