সঙ্গীত ও কবিতা
কবিতা উভয়ে ভাবপ্রকাশের দুইটি অঙ্গ ভাগাভাগি করিয়া লইয়াছে। তবে, কবিতা ভাবপ্রকাশ সম্বন্ধে যতখানি উন্নতি লাভ করিয়াছে, সঙ্গীত ততখানি করে নাই। তাহার একটি প্রধান কারণ আছে। শূন্যগর্ভ কথার কোন আকর্ষণ নাই– না তাহার অর্থ আছে, না তাহা কানে তেমন মিঠা লাগে। কিন্তু ভাবশূন্য সুরের একটা আকর্ষণ আছে, তাহা কানে মিষ্ট শুনায়। এই জন্য ভাবের অভাব হইলেও একটা ইন্দ্রিয়সুখ তাহা হইতে পাওয়া যায়। এই নিমিত্ত সঙ্গীতে ভাবের প্রতি তেমন মনোযোগ দেওয়া হয় নাই। উত্তরোত্তর আস্কারা পাইয়া সুর বিদ্রোহী হইয়া ভাবের উপর আধিপত্য বিস্তার করিয়াছে। এক কালে যে দাস ছিল আর-এক কালে সেই প্রভু হইয়াছে। চক্রবৎ পরিবর্ত্তন্তে দুঃখানিচ সুখানিচ– কিন্তু এ চক্র কি আর ফিরিবে না? যেমন ভারতবর্ষের ভূমি উর্ব্বরা হওয়াতেই ভারতবর্ষের অনেক দুর্দ্দশা, তেমনি সঙ্গীতের ভূমি উর্ব্বরা হওয়াতেই সঙ্গীতের এমন দুর্দ্দশা। মিষ্ট সুর শুনিবামাত্রই ভাল লাগে, সেই নিমিত্ত সঙ্গীতকে আর পরিশ্রম করিয়া ভাব কর্ষণ করিতে হয় নাই-কিন্তু শুদ্ধ মাত্র কথার যথেষ্ট মিষ্টতা নাই বলিয়া কবিতাকে প্রাণের দায়ে ভাবের চর্চ্চা করিতে হইয়াছে, সেই নিমিত্তই কবিতার এমন উন্নতি ও সঙ্গীতের এমন অবনতি।

অতএব দেখা যাইতেছে, যে, কবিতা ও সঙ্গীতে আর কোন তফাৎ নাই, কেবল ইহা ভাবপ্রকাশের একটা উপায়, উহা ভাবপ্রকাশের আর-একটা উপায় মাত্র। কেবল অবস্থার তারতম্যে কবিতা উচ্চশ্রেণীতে উঠিয়াছে ও সঙ্গীত নিম্নশ্রেণীতে পড়িয়া রহিয়াছে; কবিতায় বায়ুর ন্যায় সূক্ষ্ম ও প্রস্তরের ন্যায় স্থূল সমুদয় ভাবই প্রকাশ করা যায়, কিন্তু সঙ্গীতে এখনো তাহা করা যায় না। কবি Mathew Arnold তাঁহার “Epilogue to Lessing’s Laocoon” - নামক কবিতায় চিত্র সঙ্গীত ও কবিতার যে প্রভেদ স্থির করিয়াছেন, সংক্ষেপে তাহার মর্ম্ম নিজ ভাষায় নিম্নে প্রকাশ করিলাম। তিনি বলেন – চিত্রে প্রকৃতির এক মুহূর্ত্তের বাহ্য অবস্থা প্রকাশ করা যায় মাত্র। যে মুহূর্ত্তে একটি সুন্দর মুখে হাসি দেখা দিয়াছে সেই মুহূর্ত্তটি মাত্র চিত্রে প্রকাশিত হইয়াছে, তাহার পরমুহূর্ত্তটি আর তাহাতে নাই। যে মুহূর্ত্তটি তাঁহার শিল্পের পক্ষে সর্ব্বাপেক্ষা শুভ মুহূর্ত্ত সেই মুহূর্ত্তটি অবিলম্বে বাছিয়া লওয়া প্রকৃত চিত্রকরের কাজ। তেমনি মনের একটি মাত্র স্থায়ী ভাব বাছিয়া লওয়া, ভাবশৃঙ্খলের একটি মাত্র অংশের উপর অবস্থান করিয়া থাকা সঙ্গীতের কাজ। মনে কর, আমি বলিলাম, “হায়”। কথাটা ঐখানেই ফুরাইল, কথায় উহার অপেক্ষা আর অধিক প্রকাশ করিতে পারে না। আমার হৃদয়ের একটি অবস্থাবিশেষ ঐ একটি মাত্র ক্ষুদ্র কথায় প্রকাশ হইয়া অবসান হইল। সঙ্গীত সেই “হায়” শব্দটি লইয়া তাহাকে বিস্তার করিতে থাকে, “হায়” শব্দের হৃদয় উদঘাটন করিতে থাকে, “হায়” শব্দের হৃদয়ের মধ্যে যে গভীর দুঃখ, যে অতৃপ্ত বাসনা, যে আশার জলাঞ্জলি প্রচ্ছন্ন আছে, সঙ্গীত তাহাই টানিয়া টানিয়া বাহির করিতে থাকে, “হায়” শব্দের প্রাণের মধ্যে যতটা কথা ছিল সবটা তাহাকে দিয়া বলাইয়া লয়। কিন্তু কবিতার কাজ আরো বিস্তৃত। চিত্র-করের ন্যায় মুহূর্ত্তের বাহ্যশ্রীও তাঁহার বর্ণনীয়, গায়কের ন্যায় ক্ষণকালের ভাবোচ্ছ্বাসও তাঁহার গেয়। তাহা ছাড়া – জীবনের গতিস্রোত তাঁহার বর্ণনীয় বিষয়! ভাব হইতে ভাবান্তরে তাঁহাকে গমন করিতে হয়। ভাবের গঙ্গোত্রী হইতে ভাবের সাগরসঙ্গম পর্য্যন্ত তাঁহাকে অনুসরণ করিতে হয়। কেবলমাত্র স্থির আকৃতি তিনি চিত্র করেন না, এক সময়ের স্থায়ী ভাব মাত্র তিনি বর্ণনা করেন না, গম্যমান শরীর, প্রবাহমান ভাব, পরিবর্ত্তমান অবস্থা তাঁহার কবিতার বিষয়। – অতএব ম্যাথিউ আর্ণল্‌ডের মতে চলনশীল ভাবের প্রত্যেক ছায়ালোক সঙ্গীতে প্রতিবিম্বিত হইতে পারে না। সঙ্গীত একটি স্থায়ী স্থির ভাবের ব্যাখ্যা করে মাত্র। কিন্তু আমরা এই বলি যে, গতিশীল ভাব যে সঙ্গীতের পক্ষে একেবারে অননুসরণীয় তাহা নহে, তবে এখনো সঙ্গীতের সে বয়স হয় নাই। সঙ্গীত ও কবিতায় আমরা আর কিছু প্রভেদ দেখি না, কেবল উন্নতির তারতম্য। উভয়ে যমজ ভ্রাতা, এক মায়ের সন্তান; কেবল উভয়ের শিক্ষার বৈলক্ষণ্য হইয়াছে মাত্র।

দেখা গেল সঙ্গীত ও কবিতা এক শ্রেণীর। কিন্তু উভয়ের সহিত আমরা কতখানি ভিন্ন আচরণ করি তাহা মনোযোগ দিয়া দেখিলেই প্রতীতি হইবে। এখন সঙ্গীত যেরূপ হইয়াছে কবিতা যদি সেরূপ হইত তাহা হইলে কি হইত? মনে কর এমন যদি নিয়ম হইত যে, যে কবিতায় চতুর্দ্দশ ছত্রের মধ্যে, বসন্ত, মলয়ানিল, কোকিল, সুধাকর, রজনীগন্ধা, টগর ও দুরন্ত এই কয়েকটি শব্দ বিশেষ