অনুবাদ-চর্চা

২১৩

কালক্রমে আমি যৌবনপ্রাপ্ত হইলে, পিতা আমার জন্য একদল পরিচর নিযুক্ত করিলেন, এবং আমি তাঁহার আদেশে বাণিজ্যের জন্য দেশান্তরে গমন করিলাম। আমি যখন যাইতেছিলাম তখন একজন দস্যু এক অরণ্যে আমাকে আক্রমণ করিল। এবং আমার সর্ব্বস্ব লইয়া আমাকে শৃঙ্খলে বাঁধিয়া নিজেদের পল্লীতে, পশুপ্রাণগ্রাসোদ্যত কৃতান্তের জিহ্বার ন্যায় দীর্ঘ ও চঞ্চল রক্তবর্ণ পতাকান্বিত এক ভীষণ চণ্ডীমন্দিরে লইয়া গেল। তাহারা সেখানে আমাকে বলির জন্য তাহাদের দেবীপূজারত প্রভু পুলিন্দকের নিকট উপস্থিত করিল। চণ্ডাল হইলেও, আমাকে দেখিবামাত্রই তাঁহার হৃদয় করুণাবিগলিত হইল; হৃদয়ের অহৈতুক স্নেহচাঞ্চল্য পূর্ব্বজন্মের সখ্যের নিদর্শন।

২১৪

অনন্তর সেই শবরপতি হত্যা হইতে আমাকে বাঁচাইয়া যখন নিজেকেই বলি দিয়া পূজা সমাপ্ত করিতে উদ্যত হইলেন, তখন এক দৈববাণী তাঁহাকে বলিলেন, “এরূপ করিও না, আমি তোমার প্রতি প্রসন্না হইয়াছি, আমার নিকট বর প্রার্থনা করো।” তিনি ইহাতে আনন্দিত হইয়া বলিলেন, “দেবি, আপনি প্রসন্না হইয়াছেন; ইহা ছাড়া অন্য কোন্‌ বরে আমার প্রয়োজন থাকিতে পারে? তথাপি আমি ইহাই প্রার্থনা করিতেছি যে, জন্মান্তরেও যেন এই বণিকের সহিত আমার বন্ধুত্ব হয়।” “তথাস্তু” এই বলিয়া দৈববাণী নীরব হইলে, সেই শবর আমাকে প্রভূত অর্থ দিয়া স্বভবনে পাঠাইয়া দিলেন।

২১৫

হিমবান্‌ নামে এক মহাপর্ব্বত আছে–ইহা জগজ্জননীর পিতা এবং কেবল গিরিরাজ নহে, শিবেরও গুরু বটে। বিদ্যাধরগণের আবাসভূত সেই মহাপর্ব্বতে বিদ্যাধরাধিপতি রাজা জীমূতকেতু বাস করিতেন। তাঁহার গৃহে পূর্ব্বপুরুষক্রমাগত সার্থকনামা কল্পবৃক্ষ ছিল। এক দিন রাজা জীমূতকেতু তাঁহার উদ্যানে সেই দেবতাত্মক কল্পদ্রুমের নিকম উপস্থিত হইয়া প্রার্থনা করিলেন, “হে দেব, আমরা আপনার নিকট সর্ব্বদা সমস্ত দ্রব্যই পাইয়া থাকি; আমি পুত্রহীন, অতএব, আমাকে একটি বিজয়ী পুত্র প্রদান করুন!” কল্পদ্রুম বলিলেন, “রাজন্‌, আপনার এক জাতিস্মর দানবীর ও সর্ব্বভূতে দয়াবান্‌ পুত্র উৎপন্ন হইবে!” ইহা শ্রবণে রাজা আনন্দিত হইয়া কল্পবৃক্ষকে প্রণামপূর্ব্বক গমন করিলেন এবং রাণীকে এই সংবাদ জানাইয়া তাঁহার আনন্দ উৎপাদন করিলেন।

২১৬

তদনুসারে অচিরেই তাঁহার এক পুত্র উৎপন্ন হইল এবং পিতা সেই পুত্রের নাম রাখিলেন জীমূতবাহন। অনন্তর মহাসত্ত্ব জীমূতবাহন সর্ব্বভূতের প্রতি তাঁহার স্বাভাবিক অনুকম্পার সহিত বৃদ্ধি পাইতে লাগিলেন। কালক্রমে যৌবরাজ্য প্রাপ্ত হইলে তিনি একদিন জগতের প্রতি অনুকম্পাবশত নির্জ্জনে পিতাকে নিবেদন করিলেন, “তাত, আমি জানি এই সংসারে সমস্ত পদার্থই ক্ষণভঙ্গুর; কিন্তু একমাত্র মহাপুরুষগণের নির্ম্মল যশই কল্পান্ত পর্য্যন্ত টিঁকিয়া থাকে। যদি পরোপকারজনিত যশ লাভ করিতে পারা যায়, তাহা হইলে উদার ব্যক্তিগণের নিকটে তাহার মতো কোন্‌ ধন প্রাণাপেক্ষাও অধিক মূল্যবান পরিগণিত হইতে পারে?”

২১৭

“যে সম্পদে পরের উপকার করিতে পারা যায় না তাহা তো বিদ্যুতের ন্যায় কেবল ক্ষণকালের জন্য লোকচক্ষুর কষ্টই উৎপাদন করিয়া বিলীন হইয়া যায়। অতএব এই যে আমাদের অধিকারে অভিলষিত বস্তুপ্রদ কল্পবৃক্ষ রহিয়াছেন, ইঁহাকে যদি পরোপকারে লাগাইতে পারা যায় তাহা হইলে ইঁহার নিকটে সমস্ত ফল পাওয়া যাইবে। অতএব আমি সেইরূপ উপায় গ্রহণ করিতে চাহি, যাহাতে ইঁহার ধন-দ্বারা প্রার্থী জনসমূহ দারিদ্র্য হইতে মুক্ত হয়।” জীমূতবাহন পিতাকে এই আবেদন জানাইয়া ও তাঁহার অনুজ্ঞা লাভ করিয়া কল্পদ্রুমের নিকটে গমনপূর্ব্বক বলিলেন, “হে দেব, আপনি সর্ব্বদা আমাদিগকে অভীষ্ট ফল দান করিয়া থাকেন।