অনুবাদ-চর্চা
অতএব আজ আপনি আমাদের একটি অভিলাষ পূর্ণ করুন। হে বন্ধু, আপনি এই সমগ্র পৃথিবীর দৈন্য উপশম করুন! আপনার জয় হউক, আপনি ধনার্থী জগতেরই জন্য প্রদত্ত হইয়াছে।” সেই ত্যাগশীল-কর্ত্তৃক এইরূপে উক্ত হইয়া কল্পদ্রুম ভূতলে প্রচুর স্বর্ণবর্ষণ করিলেন এবং লোকেরা তাহাতে আনন্দিত হইয়া উঠিল।

২১৮

পূর্ব্বকালে কাল নামে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি পুষ্করতীর্থে গমন করিয়া সেখানে দিবারাত্রি মন্ত্র জপ করিতেছিলেন। তাঁহার জপ করিতে করিতে দেবগণের দুই অযুত বৎসর চলিয়া গেল। তখন তাঁহার মস্তক হইতে অবিচ্ছিন্ন এক মহৎ জ্যোতি আবির্‌ভূত হইল এবং ইহা দশ সহস্র সূর্য্যের ন্যায় অন্তরীক্ষে উৎসারিত হইয়া সিদ্ধ প্রভৃতির গতিকে রুদ্ধ ও ত্রিভুবনকে প্রজ্জ্বলিত করিল। তখন ব্রহ্মা, ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতারা আগমন করিয়া কহিলেন, “হে ব্রাহ্মণ, আপনার জ্যোতিতে এই সমস্ত ভুবন দগ্ধ হইতেছে। আপনার যে বর অভিলষিত হয় গ্রহণ করুন।” তিনি তাঁহাদিগকে উত্তর দিলেন, “জপ ভিন্ন অন্যত্র যেন আমার অনুরাগ না হয় ইহাই আমার বর, আমি অন্য কিছু চাহি না।”

২১৯

যখন তাঁহারা তাঁহাকে সনির্বন্ধ অনুনয় করিতে লাগিলেন, তখন সেই জপকারী সেস্থান হইতে দূরে গমন করিয়া হিমালয়ের উত্তর পার্শ্বে থাকিয়া জপ করিতে লাগিলেন। সেখানেও যখন ক্রমশ তাঁহার অসামান্য তেজ অসহ্য হইয়া উঠিল তখন ইন্দ্র তাঁহাকে বিক্ষুব্ধ করিবার জন্য প্রলোভন প্রেরণ করিলেন। কিন্তু সেই আত্মসংযমী অবিচলিত রহিলেন। অনন্তর তাঁহার নিকটে মৃত্যুকে দূতরূপে প্রেরণ করিলেন। তিনি তাঁহার নিকটে আসিয়া বলিলেন, “হে ব্রাহ্মণ, মর্ত্ত্যেরা এত দীর্ঘকাল বাঁচে না, অতএব আপনি নিজের জীবন পরিত্যাগ করুন; প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘন করিবেন না।” ইহা শুনিয়া সেই ব্রাহ্মণ বলিলেন, “যদি আমার আয়ুর সীমা পূর্ণ হইয়া থাকে, তাহা হইলে তুমি আমাকে লইয়া যাইতেছ না কেন? তুমি কিসের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছ? হে দেব পাশহস্ত, আমি স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া নিজের প্রাণ ত্যাগ করিব না, কেননা ইচ্ছা করিয়া দেহত্যাগ করিলে আমাকে আত্মঘাতী হইতে হইবে।”

২২০

এইরূপ বলিলে, তাঁহার প্রভাববশতঃ মৃত্যু যখন তাঁহাকে লইয়া যাইতে পারিলেন না, তখন যেমন তিনি আসিয়াছিলেন তেমনিই চলিয়া গেলেন। অনন্তর ইন্দ্র তাঁহাকে বলপূর্ব্বক স্বর্গে লইয়া গেলেন, সেখানে তিনি সেখানকার প্রমোদসম্ভোগে বিমুখ হইয়া জপ হইতে বিরত হইলেন না। তাই দেবতারা তাঁহাকে পুনশ্চ ভূলোকে নামাইয়া দিলেন এবং তিনিও হিমালয় প্রত্যাগমন করিলেন। সেখানে যখন দেবতারা সকলেই তাঁহাকে বরগ্রহণে সম্মত করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন তখন সেই পথে রাজা ইক্ষাকু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। যখন তিনি সমস্ত বিষয় অবগত হইলেন, তখন তিনি ঐ জপকারীকে বলিলেন, “আপনি যদি দেবগণের নিকট বর গ্রহণ না করেন তাহা হইলে আমার নিকট হইতে গ্রহণ করুন।”

২২১

জপকারী ইহা শ্রবণে হাস্য করিয়া রাজাকে বলিলেন, “আমি দেবগণের নিকট যখন বর গ্রহণ করিতেছি না, তখন আপনি বরদান করিতে পারেন!” তিনি এই কথা বলিলে ইক্ষাকু ব্রাহ্মণকে বলিলেন, “আমি যদি আপনাকে বর প্রদান করিতে সমর্থ না হই, আপনি আমাকে দিতে পারেন। অতএব আমাকে একটি বর দান করুন।” জপকারী বলিলেন, “আপনার যাহা অভীষ্ট হয় প্রার্থনা করুন, আমি আপনাকে তাহা দিব।” রাজা ইহা শুনিয়া মনে মনে বিচার করিলেন, “আমি দান করিব এবং তিনি গ্রহণ করিবেন এই বিহিত বিধান; কিন্তু তিনি দান করিবেন আর আমি গ্রহণ করিব ইহা বিপরীত বিধি।” রাজা যখন এই সঙ্কটসম্বন্ধে চিন্তা করিয়া বিলম্ব করিতেছিলেন তখন দুইটি ব্রাহ্মণ বিবাদ করিতে করিতে সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন এবং রাজাকে দেখিয়া বিচারের জন্য তাঁহার নিকট প্রার্থনা করিলেন।