বঙ্গে সমাজ-বিপ্লব

যে চিরকাল থাকিবে আমরা সে ভয় করি না, কিন্তু একটি বিষয়ে আমাদের ভয় হয়। এখন এই যে একটা সম্পূর্ণ নূতন ভাবস্রোত বহিতেছে, ইহাতে যাহা-কিছু সময়ের অনুযোগী তাহা ভাঙিয়া যাইবে বটে, কিন্তু সেইসঙ্গে যাহা উপযোগী তাহাও ভাঙিয়া যাইতে পারে, বা যাহা অনুপযোগী তাহাও নূতন ভাসিয়া আসিতে পারে, এই বিষয়ে আমাদের সাবধান হওয়া কর্তব্য; সহস্র-সহস্র বৎসর যাহা গঠিত হয়, তাহা ভাঙিয়া গেলে গড়িতে কত পরিশ্রম করিতে হইবে এবং সহস্র বৎসর যাহার ভার বহনে আমরা সমর্থ হইব, এখনই তাহা স্কন্ধে লইলে চাপা পড়িয়া মরিতে হইবে।

বঙ্গদেশের সামাজিক-বিপ্লব যে চিরকাল তিষ্ঠিতে পারিবে না, এখনই তাহার প্রমান পাইতেছি। আমাদের দেশের যুবকেরা যখন প্রথম ইংরাজি শিক্ষা পাইয়াছিলেন, তখন যাহা-কিছু দেশীয় তাহারই উপর তাঁহাদের আন্তরিক ঘৃণা ছিল ও যাহা-কিছু বিদেশীয় তাহারই উপর তাঁহাদের অতিশয় অনুরাগ জন্মিয়াছিল; এমন-কি, বিদেশীয় পানাহার চলিত হওয়াও তাঁহারা বঙ্গদেশের সভ্যতার একটি মুখ্য অঙ্গ বলিয়া মনে করিতেন; কিন্তু এখন দেখিতেছি যে ক্রমে ক্রমে তাঁহাদের সে ভাব অপনীত হইতেছে। এখন দেশীয় কাব্য, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতির উপর আমাদের অনুরাগ জন্মিতেছে ও বিদেশীয় অনেক আচার-ব্যবহারকে আমরা তুচ্ছ করিতে শিখিয়াছি। আমাদের দেশীয় কোনো লোক বিদেশীয়ের ছদ্মবেশ পরিয়া আসিলে আমরা তাহাকে ঘৃণা করি। কিছুদিন আগে কেবল ভাঙ্ ভাঙ্ শব্দ পড়িয়া গিয়াছিল, এখন সকলে রাখ্ রাখ্ করিয়া ছুটিয়া আসিতেছেন।

এখন সমাজে তিন দল উত্থিত হইয়াছেন। যাঁহারা আমূল-সংস্কার-প্রিয় তাঁহারা সকলই ভাঙিতে চান। যাঁহারা আমূল-রক্ষণ-প্রিয় তাঁহারা সকলই রাখিতে চান। যাঁহারা রক্ষণ-সংস্কার-প্রিয় তাঁহারা যাহা ভালো তাহাই রাখিতে চান, যাহা মন্দ তাহাই ভাঙিতে চান। এইরূপে উপরি-উক্ত দুইটি শক্তির ঘাত-প্রতিঘাতে এবং শেষোক্ত শক্তির উত্তেজনায় সমাজ ঠিক উন্নতির সরল পথে চলিতেছে।

উন্নতির পথ মধ্যবর্তী, উন্নতির পথ এক-ঝোঁকা নহে। কেন্দ্রাতিগ এবং কেন্দ্রানুগ শক্তি দুই দিক হইতে কোনো বস্তুর উপর কার্য করিলে তাহা মধ্যপথ আশ্রয় করে, আমূল-রক্ষণ-প্রিয় ও আমূল-সংস্কার-প্রিয় এই দুই শক্তি আমাদের সমাজের উপর কার্য করাতে সমাজ উন্নতির মধ্যবর্তী পথে অগ্রসর হইতেছে, তাহাতে আবার রক্ষণ-সংস্কার-প্রিয় উত্তেজনা করাতে সমাজ দ্বিগুন সাহায্য প্রাপ্ত হইতেছে। যাঁহারা আমূল-রক্ষণ-প্রিয় তাঁহারা উন্নতিশীল নাম ধারণ করিতে পারেন না; যাঁহারা আমূল-সংস্কার-প্রিয় তাঁহারাও উন্নতিশীল নহেন, যাঁহারা রক্ষণ-সংস্কার-প্রিয় তাঁহারাই প্রকৃত উন্নতিশীল। কিন্তু ইঁহাদের কাহাকেও সমাজ হইতে বাদ দেওয়া যাইতে পারে না। আমূল-রক্ষণ-প্রিয় মনে করিতেছেন, আমূল-উন্নতি-প্রিয় সমাজকে অবনতির দিকে আকর্ষণ করিতেছেন, আবার আমূল-উন্নতি-প্রিয় মনে করিতেছেন যে, আমূল-রক্ষণ-প্রিয় সমাজকে অবনতির গহ্বর হইতে উদ্ধার করিতে বাধা দিতেছেন, আবার রক্ষণ-সংস্কারশীল মনে করিতেছেন যে, আমূল-রক্ষণ-প্রিয় ও আমূল-সংস্কার-প্রিয় উভয়ে মিলিয়া সমাজের দারুণ অনিষ্ট সাধন করিতেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইঁহারা কেহই সমাজের উন্নতিপথের কন্টক নহেন। তবে আমূল-সংস্কার ও আমূল-উন্নতি –প্রিয় উভয়ে ভ্রান্ত পথ আশ্রয় করিয়া সমাজের উন্নতির সাহায্য করিতেছেন ও রক্ষণ-সংস্কার-প্রিয় প্রকৃত পথ আশ্রয় করিয়া সমাজের উন্নতি সাধন করিতেছেন। যখন যুবকেরা নূতন বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বহির্গত হন, যখন তাঁহাদের উন্নতির ইচ্ছা আছে কিন্তু অভিজ্ঞতা নাই, যখন তাঁহারা উন্নতির কতকগুলি মূল সূত্র শিখিয়াছেন, কিন্তু দেশ-কাল-পাত্রে প্রয়োগ করিতে শিখেন নাই, যখন তাঁহারা মনে করেন যে বলিষ্ঠ ব্যক্তিরখাদ্য ও রোগীর পথ্য একই, যখন তাঁহারা মনে করেন যে, ইংল্যান্ডের বোঝা বাংলার স্কন্ধেরউপযোগী, তখন তাঁহারা বঙ্গদেশকে একেবারে ইংল্যান্ড করিতে চান, ভাগীরথীকে টেম্‌স্ করিতে চান, বাঙালিকে ফিরাঙ্গি করিতে চান কিন্তু যখন তাঁহারা সংসারে প্রবিষ্ট হন, তখন ক্রমশ শান্ত ও শীতল হইয়া আসেন ও রক্ষণশীলতার প্রতি একটু একটু করিয়া ঝুঁকিতে থাকেন।