আবদারের আইন
হইবে তাহারই কেবল শুল্ক লাগিবে। দেশের লোকের সুখ-সুবিধার প্রতি ইহা যৎপরোনাস্তি শুভ দৃষ্টি বটে!! ‘কটন ডিউটিস্ অ্যাক্ট’ সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে সমান বর্তিবে এবং আইন হওয়ার পর হইতেই, আজ কয়েক দিন হইল উহা আমলে আসিয়াছে। দেশীয় রাজাদিগের রাজ্যও বাদ পড়ে নাই। তাহা বিদেশ ও বিলাতের মধ্যেই পরিগণিত হইয়াছে। তথাকার কল হইতে যে-সকল কাপড় সুতা ব্রিটিশ-ভারতে আসিবে তাহারও শুল্ক চাই। অতএব দেশীয় রাজার রাজ্যে গিয়াও যে কাপড় সুতার কল পাতিয়া আইনের হস্ত এড়াইবে, সে উপায়ও নাই। মাননীয় মি. ওয়েস্টল্যান্ডের এ সম্বন্ধে আমাদের উপকারে উক্তি অতি চমৎকার উপাদেয়। তাহাতে হাস্য করুণ এই উভয়বিধ বিরোধী রসেরই একত্রে উদ্রেক হয়।

কয়েক দিন ধরিয়া সুপ্রিম কাউন্সিলে এই আইনের অল্পাধিক আলোচনা হইয়াছিল। এবং তাহাতে অল্পাধিক পরিমাণে অর্থনৈতিক কথাও নিহিত ছিল। কিন্তু তাহা সমালোচনা করার স্থান নাই। তবে এক কথায় ইহা বলা যাইতে পারে যে, এ দেশের পক্ষ হইতে বেসরকারী সদস্যেরা যে-সকল তর্ক উপস্থিত করিয়াছিলেন তাহা রাজনৈতিক ও আনুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক হিসাবে এত দুর্বল যে, তাহা দাঁড়াইতে পারে নাই বলিয়া আমরা আশ্চর্য নহি।

কটন ডিউটি আইনে অন্যান্য অনিষ্ট ব্যতীত স্বদেশীয় শিল্প ও শ্রমের বিপুল অনিষ্টসাধন করিবে। এ আইন যতই সাবধানে অনুষ্টিত হউক এখন হইতে এ-দেশীয় কাপড় সুতার কলগুলিকে সরকারি পাহারার প্রচন্ড দৃষ্টির উপর সর্বদাই থাকিতে হইবে। বিন্দুমাত্রও পদঙ্খলন হইলে নিস্তার থাকিবে না। কলের কার্য ও সমস্ত কাগজপত্র যদৃচ্ছা সরকারি পরীক্ষা ও পরিদর্শনের অধীন হইবে, হিসাবের একটুকুও এদিক-ওদিক হইলে দ্রব্যের দেয় মাশুলের তিনগুণ মাশুল আদায় হইবে। সরকারি তফিখাতে কোনো রকমের তঞ্চকতা-প্রবঞ্চনাদি প্রমাণ হইলে হাজারো টাকা জরিমানা হইবে; পেনালকোড আমলে আসিবে; কলওয়ালাদিগের কারাবাসও হইতে পারিবে। কলের কাপড় সুতার স্বদেশীয় শিল্প তাহার এই শৈশবাবস্থায় আইনের এত অগ্নিপরীক্ষা পার হইয়া উঠিতে পারিবে কি না সন্দেহ। সুতরাং কলের স্বত্বাধিকারীরা স্বভাবতই মহা উৎকন্ঠিত ও আতঙ্কিত হইয়াছেন। আইনে আপত্তি করিতেছেন। কিন্তু এখন আপত্তি করা অনর্থক। ‘ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিঞ্জা যখন’। আক্ষেপ এই যে, স্বদেশহিতৈষীরা তাঁহাদিগকে ভাবিবার অবসর দেন নাই। আবদার করিয়াই এই উৎকট আইন করাইয়াছেন। আইনের উদ্দেশ্যে স্পষ্টই লিখিত আছে—

The finer classes of cotton manufactured in India enter into direct competition with the cotton manufactures imported from England. As it is intended to weight these last with an import duty, it is considered necessary to levy at the same time a countervailing duty upon the competitive classes of Indian manufactures.

অতএব আপত্তি করা এখন বৃথা। এই আইন হওয়ার অঙ্গীকারেই আমদানি-কর বসিয়াছে। আমদানি-কর না উঠিয়া গেলে, এ আইন রদেরও সম্ভবনা নাই! আমরা এ উভয়কেই সমান আপদজনক বিবেচনা করি। বেঙ্গল কাউন্সিলে ড্রেনেজ কর প্রস্তুত হইয়াছে; অবিলম্বেই আবির্ভূত হইয়া জমিদার ও রায়তের কর-ভারপীড়িত স্কন্ধ পুনঃ প্রপীড়িত করিবে। তাহার পূর্বেই কাপড়ের কর উপস্থিত। দেশে অন্নবস্ত্রের একেই তো এই সচ্ছলতা তাহার উপর আইন-কানুনের এমন সব মেওয়া ফল, পরম রমণীয়ই বটে! তবে আমাদের শত্রুশিবির হইতে বরং কিঞ্চিৎ মঙ্গল আগমনের আশা করা যাইতে পারে। আমদানি মাশুলে মাঞ্চিস্টারের মহাজন ও শক্তিশালী শ্রমজীবীগণ আপত্তি উপস্থিত করিয়াছেন। এ আপত্তি উগ্রভাব ধারণ করিলে, তাহা উল্লঙ্ঘন করা বড়ো সহজসাধ্য হইবে না; একটা সুযোগ খুঁজিয়া আমদানি কর উঠাইতেই হইবে। যদি আদৌ কোনো আশা থাকে, ইহাই এখন আশা।