আবদারের আইন
ভারত গবর্নমেন্ট সুদীর্ঘ গ্রীষ্মাবকাশের পর গৃহে এক উৎকট কর সংস্থাপনের উদ্দেশ্যে একটি অভিনব আইনের অনুষ্ঠান করিয়াছেন। সুপ্রিম কাউন্সিলের কলিকাতা অধিবেশনে এবারকার সর্বপ্রথম কার্য সুতা ও কাপড়ের উপর কর সংস্থাপন আইনের পান্ডুলিপি। ইহা প্রবাসেই প্রস্তুত হইয়াছিল; গবর্নমেন্ট পকেটে করিয়াই ইহা আনিয়াছিল; রাজধানীতে পদার্পণ করিয়াই রাজ্যমধ্যে এই পান্ডুলিপি প্রচার করেন। কয়েকদিনের মধ্যেই পান্ডুলিপি পুরা আইনে পরিণত হইয়া গিয়াছে।

ইহার— এই কাপড় ও সুতার শুল্ক-আইনের এক অংশে পুরাতনের ও পরিবর্জিতের পুনঃপ্রচার; অপর অংশ সম্পূর্ণ অভিনব, তাহা একটি স্বতন্ত্র ও সাংঘাতিক আইন। শেষোক্ত প্রথমেরই অবশ্যম্ভাবী ফল; উভয়ের একটি কিন্তু অযাচিত নয়, আকস্মিকও নয়। অনেক সময়ে আকাশ হইতে আইন আসিয়া অকস্মাৎ আমাদের মাথার উপর পড়ে। আইনের আবশ্যকতা লোকের ইষ্টানিষ্টের প্রতি অপরিসীম উপেক্ষা করিয়া গর্বমেন্ট দেশীয় সংবাদপত্র ও সভা-সমিতির অজ্ঞাতে ও অনভিমতে নূতন নূতন আইন-কানুন করিয়া থাকেন। বলা অনাবশ্যক, ইহা অন্যায়, যথেচ্ছাচার, যারপরনাই দূষণীয়। কিন্তু উপস্থিত আইনের অনুষ্ঠান সম্বন্ধে গর্বমেন্টকে এ দোষ দেওয়া যাইতে পারে না। যে কারণেই হোক, গর্বমেন্ট আত্ম-ইচ্ছা-প্রণোদিত হইয়া অযাচিতভাবে ও অকস্মাৎ এ আইনের অবতারণা করেন নাই। প্রত্যুত এ দেশে যাহা ও যাঁহারা সাধারণ অভিমতের অধিনেতা বলিয়া অভিহিত ও আত্মপরিচয় দিয়া থাকেন, তাহার ও তাঁহাদের তুমুল আন্দোলনে ও অস্বাভাবিক আবেদনে গর্বমেন্ট এই আইন উপস্থিত করিবার অবসর পাইয়াছেন, উপস্থিত করিতে অগত্যা বাধ্য হইয়াছেন। নহিলে এ আইন সম্ভবত হইত না; সহজে হইবার সুদূর সম্ভাবনা মাত্র ছিল না। গবর্নমেন্ট এ-দেশীয় লোকের প্রতি অনুগ্রহ করিয়া যে এ আইন করিতেন না, তাহা নহে; এ-দেশীয় বস্ত্রশিল্প অচিরাৎ উৎসন্নে যাইবে বা কাপড়-সুতার কল শৈশবেই স্বর্গারোহণ করিবে বলিয়া যে গবর্নমেন্ট কিছুমাত্র শঙ্কিত হইতেন তাহাও নহে; পরন্তু এ-দেশীয়দিগের পরিধেয়ের জন্যও যে পরম উৎকন্ঠিত হইয়া গবর্নমেন্ট এই আইন করিতেন না, এমনও বলি না। এ দেশের লোক অনাহার অর্ধাহারে মরুক আর উলঙ্গ অবস্থায় থাকুক বা প্রদেশীয় শিল্প-বাণিজ্য পঞ্চভূতে বিলীন হউক, তাহাতে এই গুরুগম্ভীর গবর্নমেন্টের অবিচলিত ঔদাসীন্যের এক বিন্দুও উদ‍্‌বেগ উপস্থিত হইবার আদৌ কারণভাব। কিন্তু, তথাচ এই আইন হইত না। হইত না সম্পূর্ণ অন্য কারণে। সে কারণ, সকলেই জানেন, মাঞ্চিস্টারের মহীয়সী শক্তি, লাঙ্কাশায়রের বাণিজ্যস্বার্থ। কিন্তু, শুনিতে পাই, মাঞ্চিস্টার, লাঙ্কাশায়র আমাদের শত্রু। স্বীকারই করি উহারা আমাদের পরম শত্রু। শত্রুর স্বার্থ সর্বথা হননীয় শুক্রাদির নীতি অনুসারে ইহাও আসুন, স্বীকার করি। কিন্তু, এই শত্রুদিগের স্বার্থের অনুরোধ এ-দেশীয় গরিব-দুঃখীরা একটু সুলভ বস্ত্র পরিধান করিতে পাইত; পরন্তু, সেই স্বার্থেরই অনুরোধে, এ দেশের আধুনিক অনুষ্ঠান কলের কাপড় সুতার উপর এত দিন কোনো শুল্ক সংস্থাপিত হয় নাই, ইহাও অগত্যা সকলেই স্বীকার করিতে বাধ্য। এক কথায়, শত্রুর স্বার্থে সাধারণত এ দেশেরই সুবিধা ছিল, সরল ও সত্য কথ বলিতে হইলে, অপেক্ষাকৃত সস্তা বস্ত্রে সুখও কিছু না হইয়াছিল এমন নয়। কিন্তু, তথাচ শত্রু শত্রু ভিন্ন মিত্র নহে। স্বদেশহিতৈষী সম্প্রদায়ের শত্রুহনন-স্পৃহাসমূহ বলবতী; তবে সে শক্তির অত্যন্ত অভাব বটে। কিন্তু, এ সম্বন্ধে শত্রুহননের এক মহা শুভক্ষণ উপস্থিত হইয়াছিল। কী-জানি-কোনো এক অজ্ঞতা অভিসন্ধি-সূত্রে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বণিকসম্প্রদায় মাঞ্চিস্টারের স্বার্থের বিরুদ্ধে বন্দুক সঙিন চড়াইয়া, বারুদবাহকের কার্য করিবার জন্য নেটিব পেট্রিয়টদিগকে ডাকিয়াছিলেন। সাহেবি ডাক; সামান্য নয়, অসুমার সম্ভ্রমেরই কথা। ডাক পড়িবা মাত্র পেট্রিয়টেরা, পূর্বাপর না ভাবিয়া, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করিয়া, স্বদেশের প্রকৃত, অতি প্রত্যক্ষ ও অব্যবহিত, অস্থিমজ্জায় শরীর স্বার্থ আদৌ উপেক্ষা করিয়া, তাহার একটা মরীচিকা-কঙ্কালের কল্পনায়, সাহেবদের পদ-প্রান্তে দলে