আবদারের আইন
দলে যাইয়া হাজির হন; বিদেশীয় ও বিলাতি আমদানি বস্ত্র এবং সূত্রের উপর শুল্ক সংস্থাপনের জন্য, সজোরে ও সমস্বরে হল্লা করিতে আরম্ভ করেন। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানের বিলাতি বন্দুকে নেটিব পেট্রিয়টের বাক্য-বারুদ বিক্ষিপ্ত হইয়া একটা বিষম বিসদৃশ রাজনৈতিক আওয়াজ উৎপন্ন ও উৎসারিত করে। তাহারই ফল আমাদের অদ্যকার আলোচ্যএই আইন। ইতর কথায়, ইহাকেই বলে ‘আপন নাসিক কর্তন করিয়া পরের যাত্রাভঙ্গ’। শত্রুর শুভযাত্রা ভঙ্গ করা সর্বথা কর্তব্য হইতে পারে;কিন্তু, নিজের নাসিকাটিও তো নেহাত নিস্কর্মা দ্রব্য নহে। নাসিকাটির কি একেবারেই কোনো মূল্য নাই যে, নির্মম হইয়া তাহাকে নির্মূল করিবে? কিন্তু, পরিতাপ এ-দেশীয় পেট্রিয়টেরা, প্রকৃত প্রস্তাবে তাহাই করিয়াছেন, অথচ পূর্ণমাত্রায় তাহা কাহারো যাত্রাভঙ্গের প্রতিবন্ধক হয় নাই। বিদেশীয় বস্ত্রশিল্পের শুভযাত্রা সম্যক্‌রূপে ভঙ্গ হইবে না; আদৌ এক বিন্দু ভঙ্গ হইবে কি না সে বিষয়ে সম্পূর্ণ সন্দেহ; কিন্তু স্বদেশীয় সূত্র-শিল্পের ও সুলভ বস্ত্রের নাসিকাটি নিশ্চিন্তপুরে পলায়ন করিয়াছে। নাসিকা-ছেদনজনিত যন্ত্রনায় এখন রোদন করা বৃথা। যাতনার তীব্রতার সঙ্গে এক রত্তি তামাশাও আছে। নাসা না থাকা নিজেই এক তামাশা বটে; কিন্তু, এ ব্যাপারে তদতিরিক্ত আর-একটু তামাশা আছে। নাসিকাটি কোথা হইতে কতখানি স্থান পর্যন্ত কর্তিত হইয়াছে, তাহার সহিত অন্য কোনো অঙ্গের হানি হইয়াছে কি না, আমাদের পরিচালক ও পেট্রিয়টবৃন্দ, তাহা এখনও নাকে হাত দিয়ে দেখেন নাই। সেই সামগ্রীটি ‘গিয়াছে গিয়াছে’, বলিয়াই কেবল রোদন ও রোষ প্রকাশ করিতেছেন। কেন গেল, কাহার দোষে গেল, কত দূর লইয়া গিয়াছে, নাসিকা পুনঃপ্রাপ্তির কোনো সম্ভবনা নাই, তবুও তো এ-সকল কথা এখন অনায়াসে নিশ্চিন্তভাবে ভাবিয়া দেখা যাইতে পারে। অনর্থক চিৎকার ও চাঞ্চল্য প্রকাশেই কি পুরুষার্থ?

গত বৎসর ফেব্রুয়ারির শেষে লর্ড এলগিনের রাজত্ব আরম্ভ। তাঁহার অভিষেকের অব্যবহিত পরেই প্রাথমিক ব্যবস্থাপক বেঠকে বাজেটের আলোচনা। অর্থের অনটন; অর্থাগমের অন্যতম উপায় উদ্ভাবন—ট্যারিফ ট্যাক্সের পুনঃ সংস্থাপন। ক’মাসেরই বা কথা; সকলেরই ইহা স্মরণ আছে এবং সে স্মৃতি এখনও খুব টাটকা আছে। বিদেশ ও বিলাত হইতে আমদানি বহু দ্রব্যের উপর কর বসিল; কেরোসিন তৈলের ট্যাক্স বাড়িল। পেট্রিয়টগণ পুলকিত হইলেন। ইন্‌কম ট্যাক্স বাড়িল না বলিয়া কেহ নূতন ট্যাক্স হইল না বলিয়া কেহ, বিলাতি দ্রব্যের স্পর্শে মহাপাতকগ্রস্ত হইতে ও নরক গমন করিতে হইবে না বলিয়া কেহ, পরন্তু স্বদেশীয় শিল্পী ও শ্রমজীবীদিগের সুবিধার স্বপ্ন কল্পনা করিয়া কেহ; নানা জনে নানা অনুমানে আমন্দিত হইলেন। কিন্তু এই অস্বাভাবিক আনন্দের প্রকৃত কোনো কারণ ছিল না; রক্তমাংসময় পৃথিবীর সহিতও উহার সবিশেষ কোনো সম্বন্ধ ছিল না। দেশের অনিবার্য ব্যবহার্য দ্রব্যের উপর আমদানি-শুল্ক সংস্থাপনে সজীব জাতির যেরূপ আনন্দ উৎপন্ন হয়, তাহা আমেরিকার ইতিবৃত্তেই জ্ঞাতব্য। আনন্দই বটে! সে আনন্দে অস্ত্রনির্ঘোষ, রাস্ট্রবিপ্লব ও শোণিতস্রোতেরই সম্ভবনা। কিন্তু অঙ্গহীন অসাড় জাতির সবই উল্টা। পক্ষাঘাতে পাঁচটি ইন্দ্রিয়ই বিকল, কাজেই হর্ষ-বিষাদের কারণ অনুভাবে অক্ষম। বুদ্ধিবৃত্তিও তদনুরূপ সূক্ষ্ম; সংসারের সংবাদ রাখেন তেমনি সবিশেষ; সুতরাং আমদানি-শুল্কে উপরোক্ত আমোদ অনুভূত হইয়াছিল। সে আমোদের যদি একান্তই কোনো কারণ নির্দেশ করিতে হয়—তাহার একটা কারণ হুজুগ; আর-একটা কারণ ‘হবি’। বাতিকের অশ্ব আরোহণ করিয়া অহরহ ইন্দ্রলোকে গমনের চেষ্টা। ইহাই ‘হবি’। সংসারে হবিওয়ালা লোকের অভাব নাই, হুজুগওয়ালা তো অসংখ্য। সুতরাং সেই জাতীয় লোকের মধ্যেই ওই আমদানি-শুল্কে আনন্দের উদ্রেক হইয়াছিল। নহিলে যাঁহারা সংসারের সবিশেষ সংবাদ রাখেন, বাজারের বৃত্তান্ত বুঝিয়া অপক্ষপাতে বিচার করিতে পারেন এবং দেশের অস্থি মজ্জা মেধ, দরিদ্র রায়ত ও কৃষকের সুখ-দুঃখের একটা অস্তিত্ব অনুভব করেন, তাঁহাদের কেহই এই আমদানি-শুল্কে সন্তুষ্ট হন নাই। উহাতে দেশের অন্তর্ভেদী একটি অসন্তোষই উৎপন্ন হইয়াছে। দেশের লোক অদৃষ্টবাদী বল-ও-বাক-শক্তি-বিরহিত তজ্জন্যই এ অসন্তোষ অস্ফুট ও অব্যক্ত; সংবাদপত্রে উঠে নাই, বাগ্মীর বক্তৃতায় ফুটে নাই, বলে বণিকের পণ্য-পাট লুন্ঠিত হয় নাই। লোকের বাকশক্তি ও বল থাকিলে ফল অন্যরূপ হইত। এই অন্তর্ভেদী অব্যক্ত অসন্তোষের কারণ অতীব স্পষ্ট। পেট্রিয়টিজমের প্রিয় ‘হবি’ যাহাই হউক, ইহা পরিস্কার ও প্রতিদৈনিক প্রত্যক্ষ ঘটনা যে, স্বদেশীয় বা বিলাতি বিদেশীয়ও হউক, যে দ্রব্য জনসমাজে