কবিতা-পুস্তক

জয় জয় জয়! বলিল বামা।

কার সাধ্য তোমা        করে পরাভাব

ইন্দ্র চন্দ্র যম             বরুণ বাসব!

কোথাকার ছার          তুরস্ক পহ্লব

জয় পৃথ্বীরাজ প্রথিতনামা॥

. . .

এত বলি বাম           দিল করতালি

দিল করতালি   গৌরবে উছলি '। ইত্যাদি।

আর্য-মহিষীর সহস্রবার সঘনে ‘জয় জয়’ করাতে আমাদের শৈশবকালের একটি কথা মনে পড়ে—ভূতের স্বপ্ন দেখিয়া সহসা জাগিয়া পড়িয়া যখন ভয়সূচক ক্রন্দন করিয়া উঠিতাম, তখন ওইরূপ সঘনে বারংবার ‘রাম রাম’ উচ্চারণ করিয়া ভীত ধাত্রী প্রেতযোনিকে খেদাইতে চেষ্টা করিতেন। পৃথ্বীরাজের মতো বীরপুরুষের পক্ষে দুঃস্বপ্ন দেখিয়া ভীত হওয়া এবং তাহার রানী সংযুক্তার পক্ষে সহস্র ‘জয় জয়’ ধ্বনি করিয়া আশ্বাস প্রদান করা যে কতদূর কল্পনার ব্যভিচার তাহা আর কী বলিব! সিজরের মৃত্যুর পূর্বআভাসস্বরূপ তাঁহার মহিষী যখন নানা প্রকার দুঃস্বপ্ন, নানা অমঙ্গল-লক্ষণ দেখিয়া সিজরকে রোমের সাধারণ সভাস্থলে যাইতে নিষেধ করিতে লাগিলেন তখন সিজর এই বলিয়া উত্তর দিলেন—‘ভীরুরাই প্রকৃত মৃত্যুর পূর্বে শত সহস্রবার মরিয়া থাকে—কিন্তু বীরপুরুষ একবার ব্যতীত আর মৃত্যু আস্বাদন করে না’। সে যা হউক, সংযুক্তা হিন্দুমহিলা হইয়া কেমন করিয়া ‘ইন্দ্র’ ও ‘বাসব’ ভিন্ন ভিন্ন দেবতা বলিয়া সিদ্ধান্ত করিলেন? কিন্তু সংযুক্তার এই শিক্ষার দোষ মার্জনীয় হইলেও তাঁর এরূপ স্থলে ঘন ঘন করতালি দেওয়া মার্জনীয় হইতে পারে না—তাঁহার ঘোর করতালি ‘দেখিয়া হাসিল ভারতপতি’—তিনি তো স্বচক্ষে রানীর ওরূপ উন্মাদ অবস্থা দেখিয়া হাসিবেনই—আমরা কল্পনার চক্ষে দেখিয়াই হাসি সংবরণ করিতে পারিতেছি না—ওরূপ করতালিরউপর করতালি অল্পবয়স্ক বালক-বালিকারাই সাজে—রাজরানীর তো কথাই নাই—কোনো ভদ্র কুলনারী সহসা ওরূপ করিলে তাহাকে লোকে উন্মাদ মনে করিবে না তো আর কী করিবে।

দ্বিতীয় কবিতাটি ‘আকাঙ্ক্ষা’—অর্থাৎ রাধিকা-সুন্দরী শ্রীকৃষ্ণকে কী কী হইতে অভিলাষ করিতেছেন এবং শ্যামসুন্দর তাহার কী কী উত্তর দিতেছেন তাহার একটা তালিকা। আমাদের মতে উত্তর-প্রত্যুত্তর-কবিতাতে প্রায়ই বড়ো একটা প্রকৃত কবিতা থাকিতে পারে না; কারণ উত্তরগুলি প্রায়ই হৃদয় অপেক্ষা বুদ্ধি-সাপেক্ষ—এরূপ স্থলে কেমন করিয়া খুব জবাব দিব ইহাই কবির উদ্দেশ্য হয়। প্রচীন হরু ঠাকুর বা রাম বসু প্রভৃতি কবিরা প্রশ্ন কবিতায় যতখানি কবিত্ব দেখাইয়াছেন, উত্তর কবিতায় তাহার শতাংশের একাংশও দেখাইতে পারেন নাই। স্বীকার করি যে তাহাদের উত্তরে কতকটা কারিগুরি, বাক্যবিন্যাসের কারিগুরি, দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু তাহা ব্যতীত প্রকৃত কবিতার আভাস মাত্রও কোথাও দেখিতে পাওয়া যায় না। বঙ্কিমবাবুর ‘সুন্দর সুন্দরী’ দেখিয়া শুকশারীর পুরাতন কবিতাটি আমাদের মনে পড়িল—

শুক বলে আমার কৃষ্ণ কদমতলায় থানা,

শারী বলে আমার রাধা করে আনাগনা,

                   নইলে কিসের থানা '

শুক বলে আমার কৃষ্ণ গিরি ধ’রে ছিল,

শারী বলে আমার রাধা শক্তি সঞ্চারিল,

                  নইলে পারবে কেন?