পরিশিষ্ট
ছোটো গল্প
শেষ কথা

সাহিত্যে বড়ো গল্প ব’লে যে-সব প্রগল্‌ভ বাণীবাহন দেখা যায় তারা প্রাক্‌ভূতাত্ত্বিক যুগের প্রাণীদের মতো— তাদের প্রাণের পরিমাণ যত দেহের পরিমাণ তার চার গুণ, তাদের লেজটা কলেবরের অত্যুক্তি।

অতিপরিমাণ ঘাসপাতা খেয়ে যাদের পেট মোটা তারা ভারবাহী জীব, স্তূপাকার মালের বস্তা টানা তাদের অদৃষ্টে। বড়ো গল্প সেই জাতের, মাল-বোঝাইওয়ালা। যে-সব প্রাণীর খোরাক স্বল্প এবং সারালো, জাওর কেটে কেটে তারা প্রলম্বিত করে না ভোজন-ব্যাপার অধ্যায়ের পর অধ্যায়ে। ছোটো গল্প সেই জাতের; বোঝা বইবার জন্যে সে নয়; একেবারে সে মার লাগায় মর্মে লঘু লম্ফে।

কিন্ত গল্পের ফরমাশ আসছে বড়ো বহরের। অনেকখানি মালকে মানুষ অনেকখানি দাম দিয়ে ঠকতেও রাজি হয়। ওটা তার আদিম দুর্নিবার প্রবৃত্তির দুর্বলতা। এটাই দেখতে পাওয়া যায় আমাদের দেশের বিয়ের ব্যাপারে। ইতরের মনভোলানো অতিপ্রাচুর্য এমনতরো রসাত্মক ক্রিয়াকর্মেও ভদ্রসমাজের বিনা প্রতিবাদে আজও চলে আসছে। আতিশয্যের ঢাকবাজানো পৌত্তলিকতা মানুষের প্রপৈত্রিক সংস্কার।

মানুষের জীবনটা বিপুল একটা বনস্পতির মতো। তার আয়তন তার আকৃতি সুঠাম নয়। দিনে দিনে চলছে তার মধ্যে এলোমেলো ডালপালার পুনরাবৃত্তি। এই স্তূপাকার একঘেয়েমির মধ্যে হঠাৎ একটি ফল ফ’লে ওঠে, সে নিটোল, সে সুডোল,বাইরে তার রঙ রাঙা কিংবা কালো, ভিতরে তার রস তীব্র কিংবা মধুর। সে সংক্ষিপ্ত, সে অনিবার্য, সে দৈবলব্ধ, সে ছোটো গল্প।

একটা দৃষ্টান্ত দেখানো যাক। রাজা এডওআড ভ্রমণে বেরলেন দেশ-দেশান্তরে। মুগ্ধ স্তাবকদের ভিড় চলল সঙ্গে সঙ্গে, খবরের কাগজের প্যারাগ্রাফের ঠোঙাগুলো ঠেসে ভরে ভরে উঠল। এমন সময় যত-সব রাজদূত, রাষ্ট্রনায়ক, বণিকসম্রাট, লেখনীবজ্রপাণি সংবাদপাত্রিকের ঘেঁষাঘেঁষি ভিড়ের মধ্যে একটা কোন্‌ ছোটো রন্ধ্র দিয়ে রাজার চোখে পড়ল এক অকুলীন আমেরিকানী। শব্দভেদী সমারোহের স্বরবর্ষণ মুহূর্তে হয়ে গেল অবাস্তব, কালো পর্দা পড়ে গেল ইতিহাসের অসংখ্য দীপদীপ্ত রঙ্গমঞ্চের উপর। সমস্ত-কিছু বাদ দিয়ে জ্বল্‌জ্বল্‌ করে উঠল ছোটো গল্পটি— দুর্লভ, দুর্মূল্য। গোলমালের ভিতরে অদৃশ্য আর্টিস্ট ছিলেন আড়ালে, তাকিয়ে ছিলেন ব্যক্তিগত জীবনসরোবরের গভীর অগোচরে। দেখছিলেন অতলসঞ্চারী অজানা মাছ কখন পড়ে তাঁর বঁড়শিতে গাঁথা, কখন চমক দিয়ে ওঠে তাঁর ছোটো গল্পটি নানাবর্ণচ্ছটাখচিত লেজ আছড়িয়ে।

পৌরাণিক যুগের একটি ছোটো গল্প মনে পড়ছে— ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির আখ্যান। দুঃসাধ্য তাঁর তপস্যা। নিষ্কলঙ্ক ব্রহ্মচর্যের দুরূহ সাধনায়। অধিরোহণ করছিলেন বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র-যাজ্ঞবল্ক্যের দুর্গম উচ্চতায়। হঠাৎ দেখা দিল সামান্য রমণী, সে শুচি নয়, সাধ্বী নয়, সে বহন করে নি তত্ত্ব বা মন্ত্র বা মুক্তি; এমন-কি, ইন্দ্রলোক থেকে পাঠানো অপ্সরীও সে নয়। সমস্ত যাগযজ্ঞ ধ্যানধারণা সমস্ত অতীত ভবিষ্যৎ আঁট বেঁধে গেল এক ছোটো গল্পে।

এই হল ভূমিকা। আমি হচ্ছি সেই মানুষ যার অদৃষ্ট ভীল-রমণীর মতো ঝুড়িতে প্রতিদিন সংগ্রহ করত কাঁচা পাকা বদরী ফল, একদিন হঠাৎ কুড়িয়ে পেয়েছিল গজমুক্তা, একটি ছোটো গল্প।

সাহস করে লিখে ফেলব। কাজটা কঠিন। এতে হয়তো স্বাদ কিছু-বা পাওয়া যাবে কিন্তু পেটভরা ওজনের বস্তু মিলবে না।