শেষ কথা
সেয়ানারা অবিশ্বাসে চোখ টেপাটিপি করতে পারেন তবু জোর করেই বলব সে কাহিনী মিলনান্ত বা বিয়োগান্তের যবনিকাপতনে পৌঁছয় নি কেবল আমার জেদবশত। আমার স্বভাবটা কড়া, পাথুরে জমিতে জীবনের সংকল্প ছিল যক্ষের ধনের মতো পোঁতা, সেখানে চোরের শাবল ঠিকরে প’ড়ে ঠন্‌ করে ওঠে। তা ছাড়া আমি জাত-পাড়াগেঁয়ে, সাবেককেলে ভদ্রঘরে আমার জন্ম, মেয়েদের সম্বন্ধে আমার সংকোচ ঘুচতে চায় না।

আমার জর্মন ডিগ্রি উঁচুদরের ছিল। সেটা এখানে সরকারী কাজে বাতিল। তাই সুযোগ করে ছোটোনাগপুরে চন্দ্রবংশীয় এক রাজার দরবারে কাজ নিয়েছি। সৌভাগ্যক্রমে তাঁর ছেলে দেবিকাপ্রসাদ কিছুদিন কেম‍্‍ব্রিজে পড়াশুনো করেছিলেন। দৈবাৎ জুরিকে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা। তাঁকে বুঝিয়েছিলুম আমার প্ল্যান। শুনে উৎসাহিত হয়ে তাঁদের স্টেটে আমাকে লাগিয়ে দিলেন জিয়লজিকাল সর্ভের কাজে খনি-আবিষ্কারের প্রত্যাশায়। এত বড়ো কাজের ভার আনাড়ি সিভিলিয়নকে না দেওয়াতে সেক্রেটরিয়টের উপরিস্তরে বায়ুমণ্ডল বিক্ষুব্ধ হয়েছিল। দেবিকাপ্রসাদ শক্ত ধাতের লোক, বুড়ো রাজার মন টল্‌মল্‌ করা সত্ত্বেও টিকে গেলুম।

এখানে আসবার আগে মা বললেন, “ভালো কাজ পেয়েছ, এবার বাবা বিয়ে করো।” আমি বললুম, অর্থাৎ ভালো কাজ মাটি করো।

তার পরে বোবা পাথরকে প্রশ্ন করে করে বেড়াচ্ছিলুম পাহাড়ে জঙ্গলে। সে সময়টাতে পলাশফুলের রাঙা রঙে বনে বনে নেশা লেগে গিয়েছে। শালগাছে অজস্র মঞ্জরী, মৌমাছিদের অনবরত গুঞ্জন। ব্যবসাদারেরা মৌ সংগ্রহে লেগেছে, কুলের পাতা থেকে জমা করছে তসর-রেশমের গুটি, সাঁওতালরা কুড়চ্ছে পাকা মহুয়া ফল। ঝির্‌‍ঝির শব্দে হালকা নাচের ওড়না ঘুরিয়ে চলেছিল একটি ছিপ্‌‍ছিপে নদী। শুনেছি এখানকার কোনো আধিবাসিনী তার নাম দিয়েছেন তনিকা। তাঁর কথা পরে হবে।

দিনে দিনে বুঝতে পারছি এ জায়গাটা ঝিমিয়ে-পড়া ঝাপসা চেতনার দেশ, এখানে একলা মনের সন্ধান পেলে প্রকৃতি মায়াবিনী তাকে নিয়ে রঙরেজিনীর কাজ করে, যেমন করে সে অস্তসূর্যের উত্তরীয়ে।
মনটাতে একটু আবেশের ঘোর লাগছিল। ক্ষণে ক্ষণে ঢিলে হয়ে আসছিল কাজের চাল। নিজের উপর বিরক্ত হচ্ছিলুম, ভিতর থেকে কষে জোর লাগাচ্ছিলুম দাঁড়ে। ভয় হচ্ছিল ট্রপিকাল মাকড়সার জালে জড়িয়ে পড়ছি বুঝি। শয়তান ট্রপিক্‌স্‌ জন্মকাল থেকে এদেশে হাতপাখার হাওয়ায় ডাইনে বাঁয়ে হারের মন্ত্র চালাচ্ছে আমাদের ললাটে, মনে মনে পণ করছি এর স্বেদসিক্ত জাদু এড়াতেই হবে।

বেলা পড়ে এল। এক জায়গায় মাঝখানে চর ফেলে নুড়ি পাথর ঠেলে ঠেলে দুই শাখায় ভাগ হয়ে চলে গিয়েছে নদী। সেই বালুর দ্বীপে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে সারি সারি বকের দল। দিনাবসানে তাদের এই ছুটির ছবি দেখে রোজ আমি চলে যাই আমার কাজের বাঁক ফেরাতে। ঝুলিতে মাটি পাথর অভ্রের টুকরো নিয়ে সেদিন ফিরছিলুম আমার বাংলাঘরে, ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার কাজে। অপরাহ্ন আর সন্ধ্যার মাঝখানে দিনের যে একটা ফালতো পোড়া সময় থাকে সেইখানটাতে একলা মানুষের মন এলিয়ে পড়ে। তাই আমি নিজেকে চেতিয়ে রাখবার জন্যে এই সময়টা লাগিয়েছি পরখ করার কাজে। ডাইনামো দিয়ে বিজলি বাতি জ্বালাই, কেমিক্যাল নিয়ে মাইক্রস‍্‍কোপ নিয়ে নিক্তি নিয়ে বসি। এক-একদিন রাত দুপুর পেরিয়ে যায়।

আজ একটা পুরোনো পরিত্যক্ত তামার খনির খবর পেয়ে দ্রুত উৎসাহে তারই সন্ধানে চলেছিলুম। কাকগুলো মাথার উপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলেছে ফিকে আলোর আকাশে কা কা শব্দে। অদূরে একটা ঢিবির উপরে তাদের পঞ্চায়েত বসবার পড়েছে হাঁকডাক।