শেষ কথা

অচিরা বললে, “দাদু, এইবার এসো, তোমার-আমার কথাটা আপসে চুকিয়ে দিই, কদিন থেকে মনের মধ্যে তোলপাড় করছে।”

আমি উঠে পড়লুম, বললুম, “তা হলে যাই।”

“না, আপনি বসুন।— দাদু, সেই যে কলেজের অধ্যক্ষপদটা তোমার ছিল, সেটা খালি হয়েছে। তোমাকে ডাক দিয়েছে ওরা।”

অধ্যাপক আশ্চর্য হয়ে বললেন, “কী করে জানলে ভাই।”

“তোমার কাছে চিঠি এসেছে, সে আমি চুরি করেছি।”

“চুরি করেছ! ”

“করব না! আমাকে সব চিঠিই দেখাও কেবল কলেজের ছাপ-মারা ঐ চিঠিটাই দেখালে না। তোমার দুরভিসন্ধি সন্দেহ করে চুরি করে দেখতে হল।”

অধ্যাপক অপরাধীর মতো ব্যস্ত হয়ে বললেন, “আমারই অন্যায় হয়েছে।”

“কিছু অন্যায় হয় নি। আমাকে লুকোতে চেয়েছিলে যে আমার জীবনের অভিসম্পাত এখনো তুমি নিজের উপর টেনে নিয়ে চলবে। তোমার আপন আসন থেকে আমি যে নামিয়ে এনেছি তোমাকে। আমাদের তো ঐ কাজ।”

“কী বলছ দিদি।”

“সত্যি কথাই বলছি। তুমি শিক্ষাদানযজ্ঞের হোতা, এখানে এনে আমি তোমাকে করেছি শুধু গ্রন্থকীট। বিশ্বসৃষ্টি বাদ দিলে কী দশা হয় বিশ্বকর্তার। ছাত্র না থাকলে তোমার হয় ঠিক তেমনি। সত্যি কথা বলো।”

“বরাবর ইস্কুলমাস্টারি করে এসেছি কিনা।”

“তুমি আবার ইস্কুলমাস্টার! কী যে বল তুমি! তুমি যে স্বভাবতই আচার্য। দেখেন নি, নবীনবাবু, ওঁর মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে কি আর দয়ামায়া থাকে না। অমনি আমাকে নিয়ে পড়েন— বারো-আনাই বুঝতেই পারি না। নইলে হাতড়িয়ে বের করেন এই নবীনবাবুকে, সে হয় আরো শোচনীয়। দাদু, ছাত্র তোমার নিতান্তই চাই জানি, কিন্তু বাছাই করে নিয়ো, রূপকথার রাজা সকালে ঘুম থেকে উঠেই যার মুখ দেখত তাকেই কন্যা দান করত। তোমার বিদ্যাদান অনেকটা সেই রকম।”

“না দিদি, আমাকে বাছাই করে নেয় যারা তারাই সাহায্য পায় আমার। এখনকার দিনে কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞাপন দিয়ে ছাত্র সংগ্রহ করে, আগেকার দিনে সন্ধান করে শিক্ষক লাভ করত শিক্ষার্থী।”

“আচ্ছা, সে কথা পরে হবে। এখনকার সিদ্ধান্ত এই যে, তোমাকে তোমার সেই কাজটা ফিরিয়ে নিতে হবে।”

অধ্যাপক হতবুদ্ধির মতো নাতনির মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। অচিরা বললে, “তুমি ভাবছ, আমার গতি কী হবে। আমার গতি তুমি। আর আমাকে ছাড়লে তোমার কী গতি জানই তো। এখন যে তোমার পনেরোই আশ্বিনে পনেরোই অক্টোবরে এক হয়ে যায়, নিজের নূতন ছাতার সঙ্গে পরের পুরোনো ছাতার স্বত্বাধিকারে ভেদজ্ঞান থাকে না, গাড়ি চড়ে ড্রাইভারকে এমন ঠিকানা বাতলিয়ে দাও সেই ঠিকানায় আজ পর্যন্ত কোনো বাড়ি তৈরি হয় নি, আর চাকরের ঘুম ভাঙবার ভয়ে সাবধানে পা টিপে টিপে কলতলায় নিজে গিয়ে কুঁজোয় জল ভরে নিয়ে আস।”

অধ্যাপক আমার দিকে চেয়ে বললেন, “কী তুমি বল, নবীন।”

কী জানি ওঁর হয়তো মনে হয়েছিল ওঁদের এই পারিবারিক প্রস্তাবে আমার ভোটেরও একটা মুল্য আছে।

আমি খানিকক্ষণ চুপ করে রইলুম, তার পরে বললুম “অচিরাদেবীর চেয়ে সত্য পরামর্শ আপনাকে কেউ দিতে পারবে না।”