সে
স্বপ্ন দেখছি, গরম তেল জ্বলে উঠে আমাদের কিনি বাম্‌‍নির মুখ বেবাক গিয়েছে পুড়ে; সাত দিন সাত রাত্তির হত্যে দিয়ে তারকেশ্বরের প্রসাদ পেয়েছে দু’কৌটো লাহিড়ি কোম্পানির মুন্‌লাইট স্নো; তাই মাখছে মুখে ঘ’ষে ঘ’ষে। আমি বুঝিয়ে বললুম, ওতে হবে না গো, মোষের বাচ্ছার গালের চামড়া কেটে নিয়ে মুখে জুড়তে হবে, নইলে রঙে মিলবে না। শুনেই আমার কাছে সওয়া তিন টাকা ধার নিয়ে সে ধর্মতলার বাজারে মোষ কিনতে দৌড়েছে। এমন সময় ঘরে একটা কী শব্দ শোনা গেল, কে যেন হাওয়ার তৈরি চটিজুতো হূস হূস করে টানতে টানতে ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ধড়্‌ফড়্‌ করে উঠলেম, উস্‌কে দিলেম লণ্ঠনটা। ঘরে একটা-কিছু এসেছে দেখা গেল কিন্তু সে যে কে, সে যে কী, সে যে কেমন, বোঝা গেল না। বুক ধড়্‌ফড়্‌ করছে, তবু জোর গলা করে হেঁকে বললুম কে হে তুমি। পুলিস ডাকব নাকি।

অদ্ভুত হাঁড়িগলায় এই জীবটা বললে, কী দাদা, চিনতে পারছ না? আমি যে তোমার পুপোদিদির সে। এখানে যে আমার নেমন্তন্ন ছিল।

আমি বললুম, বাজে কথা বলছ, এ কী চেহারা তোমার!

সে বললে, চেহারাখানা হারিয়ে ফেলেছি।

হারিয়ে ফেলেছ? মানে কী হল।

মানেটা বলি। পুপোদিদির ঘরে ভোজ, সকাল-সকাল নাইতে গেলেম। বেলা তখন সবেমাত্র দেড়টা। তেলেনিপাড়ার ঘাটে বসে ঝামা দিয়ে কষে মুখ মাজ‍্‍ছিলুম; মাজার চোটে আরামে এমনি ঘুম এল যে, ঢুলতে ঢুলতে ঝুপ্‌ করে পড়লুম জলে; তার পরে কী হল জানি নে। উপরে এসেছি কি নীচে কি কোথায় আছি জানি নে, পষ্ট দেখা গেল আমি নেই।
নেই!

তোমার গা ছুঁয়ে বলছি—

আরে আরে, গা ছুঁতে হবে না,বলে যাও।

চুলকুনি ছিল গায়ে; চুলকাতে গিয়ে দেখি, না আছে নখ, না আছে চুলকনি। ভয়ানক দুঃখ হল। হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলুম, কিন্তু ছেলেবেলা থেকে যে হাউহাউটা বিনা মূল্যে পেয়েছিলুম সে গেল কোথায়। যত চেঁচাই চেঁচানোও হয় না, কান্নাও শোনা যায় না। ইচ্ছে হল, মাথা ঠুকি বটগাছটাতে; মাথাটার টিকি খুঁজে পাই নে কোত্থাও। সব চেয়ে দুঃখে— বারোটা বাজল, ‘খিদে কই’ ‘খিদে কই’ বলে পুকুরধারে পাক খেয়ে বেড়াই, খিদে-বাঁদরটার চিহ্ন মেলে না।

কী বক্‌ছ তুমি, একটু থামো।

ও দাদা, দোহাই তোমার, থামতে বোলো না। থামবার দুঃখ যে কী অ-থামা মানুষ সে তুমি কী বুঝবে। থামব না,আমি থামব না, কিছুতেই থামব না, কিছুতেই থামব না, যতক্ষণ পারি থামব না।

এই বলে ধুপ্‌ধাপ্‌ ধুপ্‌ধাপ্‌ করে লাফাতে লাগল, শেষকালে ডিগবাজি খেলা শুরু করলে আমার কার্পেটের উপর, জলের শুশুকের মতো।

করছ কী তুমি।