প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
উচ্চস্বরে হাসতে লাগল বাঁশরি। বলে উঠল, “ যত বড়ো দিগ্গজ পুরুষ হোক-না সবার মধ্যেই আছে আদিম যুগের বর্বর। নিজেকে হাড়পাকা রিয়ালিস্ট বলে দেমাক করো, ভান করো মন্তর মান না। এক পলকে লাগল মন্তর, উড়িয়ে নিয়ে গেল মাইথলজিক যুগে। মনটা তোমাদের রূপকথার, সেইজন্যেই কোমর বেঁধে কলমটাকে টেনে চলেছ উজানপথে। দুর্বল ব'লেই বলের এত বড়াই। ”
পৃথ্বীশ বললে, “ সে কথা মাথা হেঁট করে মানব, পুরুষ জাত দুর্বল জাত। ”
বাঁশরি বললে, “ তোমরা আবার রিয়ালিস্ট! রিয়ালিস্ট মেয়েরা। আমরা মন্তর মানি নে। যতবড়ো স্থূল পদার্থ হও, তোমরা যা, তোমাদের তাই বলেই জানি। রঙ আমরা মাখাই নে তোমাদের মুখে, মাখি নিজে। রূপকথার খোকা সব, মেয়েদের কাজ হয়েছে তোমাদের ভোলানো। পোড়া কপাল আমাদের। এথীনা, মিনার্ভা! হায় রে হায়! ওগো রিয়ালিস্ট, এটুকু বুঝতে পার না যে, রাস্তায় চলতে যাদের দেখেছ পানওয়ালির দোকানে এঁকেছ কড়া তুলিতে যাদের মূর্তি, তারাই সেজে বেড়াচ্ছে এথীনা, মিনার্ভা। ”
বাঁশরির ঝাঁঝ দেখে পৃথ্বীশ মনে মনে হাসলে। বললে, “ বৈদিক কালে ঋষিদের কাজ ছিল মন্তর পড়ে দেবতা ভোলানো।– কিন্তু যাঁদের ভোলাতেন তাঁদের ভক্তি করতেন। তোমাদের যে সেই দশা দেখি বাঁশি। বোকা পুরুষদের ভোলাও তোমরা, আবার পাদোদক নিতেও ছাড় না, এমনি করে মাটি করলে এই জাতটাকে। ”
“ সত্যি সত্যি, খুব সত্যি! ওই বোকাদের আমরা বসাই উঁচু বেদীতে, চোখের জলে কাদামাখা পা ধুইয়ে দিই, নিজেদের অপমানের শেষ করি, যত ভোলাই তার চেয়ে হাজার গুণে ভুলি। ”
পৃথ্বীশ জিজ্ঞাসা করল, “ এর উপায় কী। ”
বাঁশরি বললে, “ তাই তো বলি অন্তত লেখবার বেলায় সত্যি কথাটা লেখো। আর মন্তর নয় মাইথলজি নয়। মিনার্ভার মুখোশটা খুলে একবার দেখো। সেজেগুজে পানের ছিপে ঠোঁট লাল করে তোমাদের পানওয়ালি যে মন্তরটা ছড়ায়, ওই আশ্চর্য মেয়েও ভাষা বদলিয়ে সেই মন্তরই ছড়াচ্ছে। সামনে পড়েছে পথচলতি এক রাজা, তাঁকে ভোলাতে বসেছে কিসের জন্যে? টাকার জন্যে। শুনে রাখো, টাকা জিনিসটা মাইথলজি নয়, ওটা ব্যাঙ্কের। ওটা তোমাদের রিয়ালিজমের কোটায়। ”
পৃথ্বীশ বললে, “ টাকার প্রতি ওঁর দৃষ্টি আছে সেটাতে বুদ্ধির পরিচয় পওয়া গেল, সেইসঙ্গে হৃদয়টাও থাকতে পারে। ”
“ আছে গো আছে। ঠিক জায়গায় খুঁজে দেখলে দেখতে পাবে পানওয়ালিরও হৃদয় আছে, কিন্তু টাকা এক দিকে হৃদয়টা আর-এক দিকে। এইটে যখন আবিষ্কার করবে তখন গল্প জমবে। পাঠিকারা ঘোর আপত্তি করবে, বলবে মেয়েদের খেলো করা হল, অর্থাৎ তাদের মন্ত্রশক্তিতে বোকাদের মনে খট্কা লাগানো হচ্ছে। উঁচু দরের পুরুষ পাঠকেরা গালি পাড়বে, তাদের মাইথলজির রঙ চটিয়ে দেওয়া, সর্বনাশ। কিন্তু ভয় কোরো না পৃথ্বীশ, রঙ যখন যাবে জ্বলে, মন্ত্র যখন পড়বে চাপা — তখনো সত্য থাকবে টিকে। ”
“ ওর হৃদয়ের ঠিকানা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি? অসভ্যতা হবে, কিন্তু লেখক তো ড্রয়িংরুমের পোষা ভদ্রলোক নয়, সে অত্যন্ত আদিম শ্রেণীর সৃষ্টিকর্তা, চতুর্মুখের তুল্য কিংবা প্রলয়কর্তা দিগম্বরের স্বজাত। ”
“ ঠিকানা বলতে হবে না, নিজের চোখেই দেখতে পাবে চোখ যদি থাকে। এখন চলো ওইদিকে, তোমাকে নিয়ে ওদের মধ্যে প্রসাদ ভাগ করে দেই গে। ”
“ তোমার প্রসাদ? ”