ললাটের লিখন

“ হ্যাঁ, আমারই প্রসাদ। আমার নিন্দে দিয়েই এর স্বাদটা হয়ে উঠেছে উপাদেয়। ”

“ দুঃখের কথা জানাই তোমাকে বাঁশরি। চাদরটাতে মস্ত একটা কালির দাগ। অন্যমনস্ক হয়ে দেখতে পাই নি। ”

“ এখানে কারো কাপড়ে কোনো দাগ নেই, তা দেখেছ? ”

“ দেখেছি। ”

“ তা হলে জিত রইল একা তোমারই। তুমি রিয়ালিস্ট, ওই কালির দাগ তোমার ভূষণ। আজও খাঁটি হয়ে ওঠনি বলেই এতক্ষণ লজ্জা করছিলে। ”

“ তুমি আমাকে খাঁটি করে তুলবে? ”

“ হাঁ, তুলব, যদি সম্ভব হয়। ”

বাঁশরির প্রত্যেক কথায় পৃথ্বীশের মনটা যেন চুমুকে মদ খাচ্ছে। এই দলের মেয়ের সঙ্গে এই ওর প্রথম আলাপ। অপরিচিতের অভিজ্ঞতায় মনটা পথ হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছে পদে পদে। কোন্‌ কথাটা পৌঁছোয় কোন্‌ অর্থ পর্যন্ত, কতদূর পা বাড়ালে পড়বে না গর্তের মধ্যে সম্পূর্ণ ঠাহর করে উঠতে পারছে না। এই অনিশ্চয়তা মনকে উদ্‌ভ্রান্ত করে রেখেছে দিনরাত। যে কথার যে উত্তর দেয় নি বাড়িতে ফিরে এসে সেইটে ও বাজাতে থাকে, ঠিক সময় কেন মনে আসে নি ভেবে হায় হায় করে। বাঁশরি ওকে অনেকটা প্রশ্রয় দিয়েছে, তবু পৃথ্বীশ বিষম ভয় করে তাকে। নিজেকে ধিক্‌কার দিয়ে বলে সাহসী পুরুষের স্পর্ধাকেই পুরস্কৃত করে মেয়েরা, যারা ওদের সসংকোচে পথ ছেড়ে দেয়, বঞ্চিত হয় তারাই। নিজের দৃঢ় বিশ্বাস, ওর গোঁয়ার্তুমি যদি হত খাঁটি গিনি সোনার দরের, বাজালে ঠন্‌ করে উঠত, তা হলে মেয়ে মহলে উড়ত ওর জয়-পতাকা। পুরুষের উপকরণে বিভীষিকা বীভৎসতার দাম আছে ওদের কাছে।

পৃথ্বীশ স্পষ্ট বুঝেছে যে, নিজেদের সমাজের উপর বাঁশরির জোর দখল। ওকে সবাই যে ভালোবাসে তা নয়, কিন্তু তুচ্ছ করবার শক্তি নেই কারো। তাই সে যখন স্বয়ং পৃথ্বীশকে পাশে করে নিয়ে চলল আসরের মধ্যে, পৃথ্বীশ তখন মাথাটা তুলেই চলতে পারলে, যদিও লক্ষ্মীছাড়া এন্ডিচাদরের কালির লাঞ্ছনা মন থেকে সম্পূর্ণ ঘোচে নি।

জনতার কেন্দ্রস্থলে এসে পৌঁছল, কিন্তু ওর উপর থেকে সমবেত সকলের লক্ষ্য তখন গেছে সরে।

সবেমাত্র উপস্থিত হয়েছে আর-একটি লোক তার উপরে মন না দিয়ে চলে না।

সোমশংকর তার কাছে বিনয়াবনত, সুষমার দেহমন ভক্তিতে আবিষ্ট। অন্য সকলে কীভাবে ওকে অভ্যর্থনা করবে স্থির করতে পারছে না, ভক্তি দেখাতেও সংকোচ, না দেখাতেও লজ্জা। দেহের দৈর্ঘ্য মাঝারি আয়তনের চেয়ে কিছু বড়ো, মনে হয় চারি দিকের সকলের থেকে পৃথক তার ঋজু সুদৃঢ় শরীর, যেন ওকে ঘিরে আছে একটা সূক্ষ্ম ভৌতিক পরিবেষ্টন। ললাট অসামান্য উন্নত, জ্বলজ্বল করছে দুই চোখ, ঠোঁটে রয়েছে অনুচ্চারিত অনুশাসন, মুখের রঙ পান্ডুর স্বচ্ছশ্যাম, অন্তর থেকে বিচ্ছুরিত দীপ্তিতে ধৌত। দাড়িগোঁফ কামানো, সুডৌল মাথায় ছোটো করে ছাঁটা চুল, পায়ে নেই জুতো, তসরের ধুতিপরা, গায়ে খয়েরি রঙের ঢিলে জামা। নাম মুক্তারাম শর্মা ; সকলেরই বিশ্বাস আসল নাম ওটা নয়। পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে ঈষৎ হেসে শান্ত হয়ে থাকে, তা নিয়ে কল্পনা করে নানা লোকে নানা প্রকার, কোনোটা অদ্ভুত অপ্রাকৃত, কোনোটা কুৎসায় কটু। ওর শিক্ষা য়ুরোপে এইরকম জনশ্রুতি — নিশ্চিত প্রমাণ নেই। কলেজের ছেলেরা অনেকে ওর কাছে আসে পড়া নেবার জন্যে, তাদের বিশ্বাস পরীক্ষায় উতরিয়ে দিতে ওর মতো কেউ নেই, অথচ কলেজি শিক্ষার 'পরে ওর নিরতিশয় অবজ্ঞা। এই শেখাবার উপলক্ষ করে ছেলেদের উপর ওর প্রভাব পড়ছে ছড়িয়ে। এমন একদল আছে যারা ওর জন্য প্রাণ দিতে পারে। এই ছেলেদের ভিতর থেকে বাছাই ক'রে ও একটি অন্তরঙ্গ চক্র তৈরি করেছে কি না কে জানে — হয়তো করেছে। ছুটির সময় একদলকে সঙ্গে নিয়ে ও