প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
সুষমা যখন প্রথম কলেজে প্রবেশ করেছে তখন মুক্তারামের কাছে ওর পাঠ আরম্ভ। বাঁধা পাঠ্য বইটাকে গৌণ করে শিক্ষক পড়িয়েছে আপন মত অনুসারে নানা বিষয়ের বই। ছুটির সময় যথাযোগ্য স্থানে নিয়ে গিয়ে ওকে ছুরি খেলতে, ঘোড়ায় চড়তে, ডিঙি নৌকো দুহাতে দাঁড় ধরে বাইতে করেছে পটু, মোটর গাড়ির কলের তত্ত্ব, চালানোর কৌশল নিপুণ করে শিখিয়েছে।
সুষমার বিধবা মা ব্রাহ্মসমাজের মেয়ে। এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠান ব্রাহ্মমতে উপাসনা করে হয় এই তার ছিল ইচ্ছে। সুষমা জিদ করে ধরে পড়ল অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হবে মুক্তারামকে দিয়ে। মুক্তারামের কোন্ সম্প্রদায় কেউ জানে না, ব্রাহ্মসমাজে তার গতিবিধি নেই, আর অচরণ নয় নিষ্ঠাবান হিন্দুর মতো। সুষমার মা বিভাসিনী গভীর ভক্তি করে মুক্তারামকে, তবু তার ইচ্ছা ছিল সমাজের লোক দিয়েই ক্রিয়াটা নিষ্পন্ন হয়। সুষমা কোনোমতেই রাজী হল না। আজ মুক্তারামের আহ্বান এখানে সেই কারণেই।
মুক্তারামকে সবাই সংকোচ করে, বাঁশরি করে না। সে এসেই একটি ছোটরকম নমস্কার করে বললে, “ সুষমার মাস্টরিতে আজ শেষ ইস্তফা দিতে এসেছেন?”
“ কেন দেব? আরো একটি ছাত্র বাড়ল। ”
বাঁশরি সোমশংকরের দিকে তীব্র কটাক্ষ হেনে বললে, “ তাকে মুগ্ধবোধের পাঠ শুরু করাবেন? ওই দেখুন-না, মুগ্ধতার তলায় ডুবেছে মানুষটা, হঠাৎ ওর বোধোদয় কোনোদিন হয় যদি সেদিন ডাক্তার ডাকতে হবে। ” মুক্তারাম কোনো উত্তর না করে বাঁশরির মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকালে। নীরবে জানালে একে বলে ধৃষ্টতা। বাঁশরির মতো মেয়েও কুন্ঠিত হল এই দৃষ্টিপাতে।
স্বল্পজলা নদীর স্রোতঃপথ প্রশস্ত হয়ে এখানে-ওখানে চর পড়ে যেরকম দৃশ্যটা হয় সেইরকম চেহারা বিভাসিনীর। শিথিল প্রসারিত হয়েছে দেহ, কিছু মাংসবাহুল্য ঘটেছে তবু চাপা পড়ে নি যৌবনের ধারা। তার সৌন্দর্য স্বীকার করতে হয় আজও। পতিকুলে মেয়েটি ছাড়া আর কেউ নেই তার, স্বামীর দত্ত সম্পত্তি থেকে সংসারের অভাব সহজেই পূরণ হয়ে আরো কিছু হাতে থাকে। কন্যার ভবিষ্যৎ লক্ষ করে সেই টাকা এতদিন সঞ্চিত হয়েছে বিশেষ যত্নে। সোমশংকরের সঙ্গে মেয়ের বিবাহ প্রস্তাবের পর থেকে সেই দায়িত্বের টান এসেছে আলগা হয়ে।
এই বিবাহ যে হতে পারে এ ছিল অভাবনীয়। সবাই জানত রাজকুমার সম্পূর্ণ বাঁশরির প্রভাবের অধীনে, কেউ যে তার নাগাল পেতে পারে এ কথা মনে হত অসম্ভব। কিন্তু সেসময় বেঁচে ছিল পূর্বতন রাজা প্রভুশংকর, বাঁশরির সঙ্গে সোমশংকরের বিবাহের প্রধান বাধা। অল্পদিন হল পিতার মৃত্যু হয়েছে। তবু জাতের বাধা কাটতে চায় না। ক্ষত্রিয়বংশের বাইরে রাজার বিবাহ প্রস্তাবে প্রজারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এমন সময়ে মুক্তারাম এই সম্বন্ধ পাকা করলেন কী করে সেই এক কাহিনী।
বিভাসিনী এসে সংবাদ দিল, সময় উপস্থিত। ঘরের ভিতরে বেদি রচনা করে সভার স্থান হয়েছে। নিমন্ত্রিতেরা সবাই চলল সেইদিকে। বাঁশরির নিমন্ত্রণ হয় নি, তা ছাড়া কন্যাপক্ষের ইচ্ছে ছিল না সে উপস্থিত থাকে। বাঁশরি এসেছে ভদ্ররীতি এবং ভদ্রসমাজকে উপেক্ষা ক'রে। তার দৃঢ় পণ সে থাকবে অনুষ্ঠান-সভার মধ্যেই। কেউ-বা হাসবে, কেউ-বা রাগবে, কিন্তু কিসের কেয়ার করে সে। মনকে শক্ত করে মাথা তুলে পা বাড়াচ্ছিল ঘরের মধ্যে, পা গেল কেঁপে, বোধ করি চোখে আসছিল জল, পারলে না ঘরে যেতে, আটকে রইল বাইরে।
পৃথ্বীশ জিজ্ঞাসা করলে, “ ঘরে যাবে না?”
বাঁশরি বললে। “ না, সস্তাদামের সদুপদেশ শুনলে গায়ে জ্বর আসে। ”
“ সদুপদেশ! ”
“ হাঁ, উপদেষ্টার শিকারের এই তো সময়, যাকে বলে সুবর্ণ সুযোগ। পায়ে দড়ি-বাঁধা জীবের 'পরে নিঃশেষ করে দেয়