প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
“ তা হলে সুষমাকে কিসের প্রয়োজন? ”
“ অন্ন চাই যে। ব্রহ্মচারীকেও ভিক্ষার জন্য আসতে হয় মেয়েদের দ্বারে। রাজভান্ডারের চাবি দিতে চান ওর হাতে। রোসো অনুষ্ঠানটা শেষ হয়ে আসছে, এইবার ঘরে ঢুকে দেখে আসি গে। ”
গেল ঘরের মধ্যে। তখন মুক্তারাম বলছে, “ তোমরা যে সম্বন্ধ স্বীকার করছ, জেনো, সে আত্মপ্রকাশের জন্যে, আত্মবিলোপের জন্যে নয়। যে-সম্বন্ধ মুক্তির দিকে নিয়ে চলে তাকেই শ্রদ্ধা করি, যা বেঁধে রাখে পশুর মতো তা প্রকৃতির হাতে গড়া প্রবৃত্তির শিকলই হোক আর মানুষের কারখানায় গড়া দাসত্বের শিকলই হোক — ধিক্ তাকে। ”
উজ্জ্বল হয়ে উঠল সুষমার মুখ, যেন সে দৈববাণী শুনলে। মুক্তারামের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলে।
চৌরঙ্গি অঞ্চলে বাঁশরিদের বাড়ি। সেখানে ওর দুই অবিবাহিত ভাই থাকে। পাটনা অঞ্চলে থাকতে হয় বাপকে বেহার গবর্মেন্টের কোন্ কাজে। মা প্রায়ই থাকে তারই সঙ্গে, মেয়েকে রাখতে চায় কাছে, মেয়ে কলকাতা ছেড়ে যেতে নারাজ।
পৃথ্বীশকে বাঁশরি এত প্রশ্রয় দেয়, সেটা একেবারেই পছন্দ করে না ভাইরা। সবাই জানে বাঁশরির বুদ্ধি অসামান্য তীক্ষ্ণ, মেয়েদের দিক থেকে সেটা একেবারেই আরামের নয়, তা ছাড়া ওর অধিকাংশ সংকল্প দুঃসাহসিক হিংস্র প্রাণীর মতো, শুধু যে লম্বা লাফ দিতে পারে তা নয়, সঙ্গে থাকে প্রচ্ছন্ন কোষে তীক্ষ্ণ নখর। ওর ভাইরা সুযোগ পেলেই পৃথ্বীশের চেহারা নিয়ে, লেখা নিয়ে ঠাট্টা করে, কিন্তু এ বাড়িতে যাতায়াতের বাধা দেবার আভাসমাত্র দিতে সাহস পায় না।
পৃথ্বীশ জানে এদের ঘরে তার প্রবেশ অনভিলষিত। তাই নিয়ে ওখানকার দ্বারী থেকে আরম্ভ করে সমস্ত পুরুষ অধিবাসীর কাছে ওর সংকোচ ভাঙতে চায় না — ও কেবলই মনে করে, ওর আদ্যোপান্ত সমালোচনা করে সবাই, বিশেষত কপালের সেই দাগটার। এদের বাড়িতে অন্য যে-সব অভ্যাগতদের আসতে দেখে, তারা সাজে সজ্জায় ভাবে ভঙ্গিতে ওর থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র শ্রেণীর মানুষ। ও চেষ্টা করে নিজেকে বোঝাতে যে ওরা ডেকোরেটেড ফুল্স্, কিন্তু সেই স্বগতোক্তিতে লজ্জা চাপা পড়ে না। ও যখন দেখে অন্যরা এখানে আসে স্বাধিকারের নিঃসংকোচে তখন আপন সাহিত্যিক আভিজাত্যবোধকে মনে মনে সবলে স্ফীত করে তুলেও নিজেকে ওদের সমান বহরে দাঁড় করাতে পারে না। সেটা বোঝে বাঁশরি এবং এও বোঝে যে বাঁশরির দিকে ওর আকর্ষণ প্রতিদিন প্রবল হয়ে উঠছে অন্তত তার একটা কারণ এই শ্রেণীগত দুরধিগম্যতা। বাঁশরির সামীপ্যে ওর মনে একটা অহংকার জাগে, ইচ্ছে করে দেখুক সব বাইরের লোকে। এই অহংকারটা ওর পক্ষে লজ্জার কারণ। তা জেনেও পারে না সামলাতে। একটা কথা বুঝে নিয়েছে বাঁশরি যে, ওদের বাড়িতে হেঁটে আসতে বাধে পৃথ্বীশের। যখন দরকার হয় নিজের গাড়ি পাঠিয়ে দেয় ওকে আনতে। অর্থাভাবগ্রস্ত পৃথ্বীশ শোফারকে মোটা বকশিস দিতে ভোলে না।
আজ শৌখিনমন্ডলীর দিনারম্ভে অর্থাৎ বেলা আটটায় গাড়ি পাঠিয়েছিল বাঁশরি। সেদিন পৃথ্বীশের হল অকালবোধন। তারও দিনগণনা হয় পূর্বাহ্নের প্রথম কটা ঘন্টা বাদ দিয়ে। বাঁশরির ভাইরা তখন বিছানায় শুয়ে আধ-মেলা চোখে চা খাচ্ছে। সূর্যের যেমন অরুণ সারথি, ওদের জাগরণের তেমনি অগ্রদূত গরম চায়ের পেয়লা। পৃথ্বীশ যখন এল বাঁশরির চুলবাঁধা তখন শিথিল, মুখ ফ্যাকাসে, আটপৌরে শাড়ি, পায়ে ঘাসের জাপানি চটি। মুগ্ধ হল পৃথ্বীশের মন, অসজ্জিত রূপের মধ্যে অন্তরঙ্গতা আছে, তাতে দুরু দুরু কাঁপিয়ে দিল ওর বুকের ভিতরটা। ইচ্ছে করতে লাগল মরীয়া হয়ে দুঃসাহসিক কথা একটা কিছু বলে ফেলে। মুখে বেধে গেল, শুধু বললে, “ বাঁশি, আজ তোমাকে দেখাচ্ছে সকালবেলাকার অলস চাঁদের মতো। ”
বাঁশরির স্পষ্ট করে বলতে ইচ্ছে করছিল ‘অকরুণ বিধাতার শাপ তোমার মুখে। মুগ্ধ দৃষ্টি তোমাকে মানায় না। দোহাই তোমার, গদগদ ভাবটা রেখে দিয়ো আপন নির্জন ঘরের বিরহের জন্য জমিয়ে। ' পৃথ্বীশের মুখের 'পর চোখ রাখা বাঁশরির পক্ষে